ভরসা রাখুন ; আসুন সাথে, লড়াই হবে ; ঝান্ডা হাতে।
সুকুমার চক্রবর্তী
আমার – আপনার এ দেশ, এই রাজ্য, এই জেলা, এই গ্রাম। নদিয়া জেলার বসবাসকারী জনসংখ্যার ৭২ শতাংশই গ্রামে বাস করেন।
গ্রাম প্রধান নদীয়া জেলার প্রধান উপজীবিকা হল – কৃষিক্ষেতে কাজ। বর্তমান সময়ে বহুচর্চিত কৃষি সংকট – ই দেশের সবথেকে বড় সংকট।
কৃষির বর্তমান এই সংকটের কারণে ১৯৯৫ – ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়কালে ৪ লক্ষাধিক কৃষক ও কৃষি নির্ভর মানুষের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। নরেন্দ্র মোদির শাসনের শেষ কয়েক বছরে কৃষকের আত্মহননের ঘটনা ঘটেছে ১লাখের উপর!
মোদি সরকার এখন সরকারি কোনো তথ্য, প্রকাশ্যে দিতে রাজি নয়। ২০০১ – ২০১১ সাল সময়কালেই ৯০ লক্ষ কৃষক, কৃষিকাজ ছেড়ে দিয়েছে। অপরদিকে খেতমজুর তথা কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ৩ কোটির উপর। ২০১৫ – ২০১৬ সালে গ্রামীণ পরিবারগুলির ৪৭ শতাংশের নিজস্ব কোন জমি নেই। হু হু করে বাড়ছে অকৃষক জমির মালিকের সংখ্যা। দেশে বিভিন্ন পেশায় শ্রমদানকারী মানুষের ৮৩ শতাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে চালু হওয়ার শ্রমকোডের ফলে তারা বিধিবদ্ধভাবে শ্রমিক হিসাবে পরিচিত নয়। ২০০৮ সালের পর থেকে শ্রমজীবীদের দৈনিক প্রকৃত মজুরি এক পয়সাও বাড়েনি। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার কোন সমতা নেই। বাজার থেকে দৈনন্দিন সংগ্রহ করতে হয়, এমন জিনিসপত্রের খুচরো দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশের শীর্ষে। সারাদেশে দাম বৃদ্ধির হার যেখানে ৭শতাংশ, তখন পশ্চিমবঙ্গে দাম বৃদ্ধির হার ৯ শতাংশের কাছাকাছি। এক দেশ এক রেশন ব্যবস্থার নামে এখনকার রেশনিং ব্যবস্থা থেকে প্রতিদিন ছিটকে পড়ছে বিপুল সংখ্যক রেশনহীন মানুষ। বিনামূল্যে জোগান দেওয়া খাদ্যশস্য রেশন ব্যবস্থায় বন্ধ হচ্ছে। প্রতি ৪ সেকেন্ডে ১ জনের মৃত্যু সংবাদ এখন সংবাদের শিরোনামে। কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং নিশ্চয়তা কোনোটাই নেই। বামপন্থীদের বহু লড়াইয়ের পর ইউপিএ – ১ সরকারের আমলে, গ্রামীণ শ্রমজীবীদের জন্য আদায় করা সম্ভব হয়েছিল কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা লক্ষ্যে একটি আইন (বর্তমানে যা MGNREGA)। যে আইনের ফলশ্রুতিতে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প চালু হয়েছিল। সেই সময়ে এই আইন চালু হবার প্রথম দিন থেকেই নরেন্দ্র মোদী এবং তার দল বিজেপি সোচ্চার বিরোধিতা করেছিল। এমনকি শেষ আর্থিক বছরে যে বাজেট পেশ তারা করেছে সেখানেও ২৫ হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ ছাঁটাই করেছে। সারাদেশেই রেগা আইনে কাজ করা জব কার্ডধারীদের মজুরি বকেয়া! পশ্চিমবঙ্গে বকেয়া মজুরির পরিমাণ ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। গত ছয় মাস ধরে বকেয়া। চলতি সময়ে রেগা প্রকল্পের বরাদ্দ বাবদ রাজ্যের পাওনা ৬৭৩৪ কোটি টাকা। ১ কোটি ৫২ লক্ষ ৭৬ হাজার ৫৬৯ টি পরিবারের হাতে জব কার্ড থাকলেও, ২০২২ সালে ১৬ লক্ষ ১৩ হাজার ৫২৫ টি পরিবার রেগা আইনে কাজ পেয়েছে। এরাজ্যের তৃণমূল সরকার, ঘোষিত কৃষিতে কাজ করা মজুরদের ন্যুনতম মজুরি (Minimum Wage) অনুসারে, যে মজুরি দেওয়ার কথা তার থেকেও রেগার বর্তমান মজুরি কম বরাদ্দ করেছে। এছাড়া বকেয়া মজুরি মেটাতে অতিরিক্ত অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়ার দাবি অস্বীকার করছে।
রেগার কাজে মেয়েদের ক্ষেত্রে বৈষম্য নজর কাড়ে। ২০২১ – ২০২২ সালে সারাদেশে রেগার কাজ হয়েছে গড়ে ৯৪ দিন অথচ মহিলাদের কাজের সুযোগ দেওয়া গেছে মাত্র ৩৩ দিন! রেগার কাজে মহিলাদের নিযুক্তি প্রতিবছর কমছে। দেশে বেকারির হারে যখন সর্বোচ্চ অবস্থান, তখন গত ১লা থেকে ২১ অক্টোবর’২২ সময়কালে ১কোটি ৫ লাখ বেগায় কাজ পাওয়ার আবেদনকারীদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে সরকার।
বেহাল গ্রামের কৃষি ব্যবস্থা! মোদি জানিয়েছিলেন, দেশের কৃষকদের গড় মাসিক আয় দ্বিগুণ করা হবে। অপরদিকে এ রাজ্যের মমতা ব্যানার্জি জানিয়েছিলেন, কৃষকের প্রকৃত আয় করা হবে তিন গুণ। অথচ জাতীয় কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের তরফে প্রকাশিত তথ্যে জানা যাচ্ছে যে, গোটা দেশের ২৮ টি রাজ্যের তালিকার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ২২ নম্বরে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের গড় মাসিক আয় মমতা ব্যানার্জি দাবি করছেন ২৫ হাজার টাকা! আর NABARD এর দাবি, তা কখনোই ৭ হাজার ৭৫৬ টাকার বেশি নয়! পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে ঋণের জোগান প্রতি একরের জন্য ২২ হাজার টাকার বেশি নয়। পশ্চিমবঙ্গ সর্বভারতীয় তালিকায় এখন ১৫ নম্বরে। পশ্চিমবঙ্গে কিষান ক্রেডিট -কার্ডের ঢংকানিনাদ প্রচার সত্ত্বেও কৃষি কাজের ঋণের জোগানের জন্য মাইক্রো ফিন্যান্স কোম্পানিগুলির কাছে যেতে বাধ্য হচ্ছে – এ রাজ্যের কৃষক সমাজ।গ্রামাঞ্চলে কৃষি ব্যবস্থায় সেচ দেওয়ার জন্য যে ডিপটিউবয়েল – রিভার লিফট – ইরিগেশন এবং সাবমারসিবল প্রকল্প গুলি চালু ছিল, তা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কার্যত বন্ধ। ডিজেল এবং বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি হওয়ার ফলে সেচের খরচ বেড়েছে বহুগুণ। নতুন করে কৃষিতে সেচের কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না। লাগামছাড়া দুর্নীতির কবলে সরকারি সমস্ত উন্নয়নের প্রকল্প। গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির হাতে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের ১৮০০ কোটি টাকা পড়ে আছে। নদীয়া জেলায় পড়ে থাকা টাকার পরিমান ১০৩ কোটি । গ্রামীণ জনপদ – পরিবহন বিপর্যস্ত! গ্রামীণ রাস্তা গুলির বেহাল দশা – কোনোরূপ সংস্কার নেই। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই নতুন নতুন বসতি গড়ে উঠেছে — সেই বসতি গলিতে না আছে রাস্তা! না গেছে বিদ্যুৎ! না পৌঁচেছে পানীয় জলের পাইপলাইন! গ্রামে গেলে দেখা যাবে পঞ্চায়েত কর্তাদের রঙিন নকশা করা পেল্লায় বসতবাড়ি। পঞ্চায়েত কর্তাদের বাহন হয়েছে এখন এনফিল্ড বুলেট গাড়ি। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন তাদের কব্জায় — সাধারণ প্রশাসন তাদেরই কথায় ওঠা -বসা করে। গ্রামীণ গঞ্জগুলিতে গড়ে উঠেছে এক ধরনের মাফিয়া শ্রেণী, তারা বর্তমানে রাজনৈতিক মদত পেয়ে গ্রামের সকল প্রতিষ্ঠান – ক্লাব – লাইব্রেরী – সমবায় – বারোয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলির রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পঞ্চায়েত কর্তাদের শাসন। বিচারালয়ের নির্দেশে চাকরি দুর্নীতি তদন্তে নেমে টাকার পাহাড় সমেত ধরা পড়েছে কয়েকজন মন্ত্রী এবং প্রশাসক। মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে টেলিভিশনের পর্দায় সে ছবি। মানুষই দেখেছে কিভাবে তোয়ালেতে মুড়ে তৃণমূলের নেতারা হাওলা কেলেঙ্কারিতে টাকা আত্মসাৎ করেছে। “তৃণমূল নেতাদের চোর” বলতে মানুষ দাঁড়িয়ে থেকেছে আদালত চত্বরে। মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহস নেই এখন তৃণমূলীদের। ফায়দা নিতে বিজেপি প্রচার করছে — তারাই এ লড়াই লড়ছে। কিন্তু মানুষ জানে বিজেপি ধোয়া তুলসী পাতা নয়। বিজেপি শাসিত রাজ্য গুলিতে একের পর এক দুর্নীতির ঘটনা উন্মোচিত হচ্ছে। এমনকি চাকরি দুর্নীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে এ রাজ্যের মতই ত্রিপুরাতে বিজেপি নির্মমভাবে পুলিশ দিয়ে চাকরির দাবির আন্দোলনের উপর লাঠি চালিয়েছে — মানুষ তা দেখেছে। দুর্নীতিগ্রস্ত এই নেতাদেরই তদন্তের চাপ তৈরি হলে তৃণমূল থেকে বিজেপি আবার বিজেপি থেকে তৃণমূলে অবাধ দলবদল ও যাতায়াতের ছবি এখন পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদিন। চোখখুলে তাকালেই দেখবেন তৃণমূল ও বিজেপি কর্তারা একই কায়দায় আবাস নির্মাণ – রেশন কার্ড – ভাতার টাকা – রেগার মজুরির টাকা আত্মসাৎ করছে। রেকর্ড বেকারি – অনাহার – অপুষ্টি – মূল্যবৃদ্ধি – কর্মহীনতার তীব্র যন্ত্রণার মুখে দাঁড়িয়ে জীবন যুদ্ধে অগ্রসর হতে – নিজেদের পরিবারের সন্তান-সন্ততিদের ভবিষ্যৎ গড়তে – লড়াই ছাড়া অন্য কোন পথ সামনে খোলা নেই। পরিকল্পনাবিদ সত্যব্রত সেন – বিনয় চৌধুরী – প্রমোদ দাশগুপ্ত – জ্যোতি বসুদের হাতে গড়া বিকেন্দ্রীভূত জনমুখী ত্রিস্তর পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা আজ বিপর্যস্ত ওদের হাতে। মানুষের অংশগ্রহণ নির্ভর বিকেন্দ্রীভূত জনমুখী এই পঞ্চায়েতে ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন এ জেলার কয়েক লক্ষ বামপন্থী কর্মীদের সঙ্গে অমৃতেন্দু মুখার্জি – সমর সান্যাল – পরিমল বাগচী – শান্তি ভট্টাচার্যেরা — সেই পঞ্চায়েতকে উদ্ধার করবার সুযোগ আসছে সামনে। দ্বিধা দ্বন্দ্ব – দোদুল্যমানতা কাটিয়ে -জড়তা কাটিয়ে – ভয় মুক্ত চিত্তে চলুন এগিয়ে যাই। ভরসা রাখুন – আস্থা রাখুন – বদলাবো আমরাই – বামপন্থীরাই। লড়াই করেই বদল হবে। বদলের দীপ্ত সংকেত নিয়ে এই নভেম্বর মাসজুড়ে গ্রামের প্রতিটি প্রান্তে আয়োজিত হচ্ছে কৃষক খেতমজুর ও গ্রামীণ শ্রমজীবীদের মেজাজি পদ যাত্রা। সাথে আছেন মহিলারা আর এপ্রজন্মের তরুণ ছাত্র যুবরা। আসুন এ পদযাত্রায়- আপনিও পা মেলান। এযাত্রা ভুমি ছুঁয়ে বুথ ধরে গ্রামের প্রত্যন্তে শ্লোগান মুখরিত হয়ে হাঁটছে। প্রতিবাদের ভাষা রাস্তায় দাবী জানাচ্ছে – “পঞ্চায়েতে পঞ্চায়েতে দুর্নীতির ঘুঘুর বাসা ভাঙ্গো।” গ্রাম জাগছে, গ্রামবাসী হাঁটছে নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে। কোনো টিভির পর্দায় দেখানোর জন্য বামপন্থীরা লড়াই করে না! মানুষের দাবী মানুষ নিজেই স্বচক্ষে দেখছে – ‘নিজের বুথের রাস্তায় – লাল ঝান্ডাকেঃ বিশ্বাসে, ভরসায়, আস্থায়, অধিকারের লড়াইতে।’