যেমন দেখেছি মানব মুখার্জিকে
🖋বাদল দত্ত
আশির দশকের গোড়ার দিক থেকেই মানব মুখার্জি আমার কাছে একটি পরিচিত নাম। মানব মুখার্জি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক। খুবই জনপ্রিয় ছাত্রনেতা। ১৯৮৪ সালে এসএফআই’র কলকাতা জেলা কমিটির সভাপতি। রাজ্যেরও নেতা। আমার কাজের ক্ষেত্র তখন চাকদহ, নদিয়া। ছাত্রনেতা হিসেবে তখন চাকদায় ভাষণ দিতে এসেছেন। শুনেই মুগ্ধ হয়েছি। শব্দচয়নে,বাক্যবিন্যাসে, যুক্তিতর্কে একেবারেই আলাদা। অন্যরকম। অত্যন্ত আকর্ষণীয়। অনেকবার এসেছেন নদিয়ায়। ১৯৯০ সালের ১-২ আগস্ট নদিয়া জেলার রসুল্লাপুরে ডিওয়াইএফআই নদিয়া জেলা কমিটির উদ্যোগে দু’দিনের শিক্ষা শিবির। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে বললেন বরেণ বসু।সংগঠন নিয়ে রবীন দেব। আর জাতীয় পরিস্থিতি নিয়ে বললেন মানব মুখার্জি। সে সময়েই শিক্ষার্থীরা নতুন প্রজন্মের নতুন নেতাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের ২-৪ অক্টোবর সল্টলেক স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য অষ্টম সম্মেলনে সম্পাদক নির্বাচিত হন মানব মুখার্জি। সে সময় থেকে কখনও যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে, কখনও বা সহ-সভাপতি হিসেবে মানব মুখার্জির সহযোগী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। শুধু রাজ্য কমিটির সভা, রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সভা, রাজ্য কাউন্সিল সভা বা কেন্দ্রীয় কর্মসূচিই নয়, বেশ কিছু জেলার কর্মসূচিতে একসাথে অংশ নিতে পেরেছি। সভা পরিচালনায়, সভায় যুক্তি তর্কে এবং কর্মসূচির ফাঁকে একান্ত আড্ডায় মানব মুখার্জিকে পেয়েছি নানা ভাবে। প্রতিটি উপস্থিতিতে মানব মুখার্জি নতুন চিন্তার খোরাক জুগিয়ে গেছেন। সমৃদ্ধ করেছেন সবাইকে। ১৯৯২ সালের ২৪ মে বাদকুল্লা ধানহাটে ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন নদিয়া জেলা নবম সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশে জনতার জমজমাট জমায়েতকে উদ্দীপ্ত করেছিল মানব মুখার্জির ভাষণ। বহুবার বহু কর্মসূচিতে এসেছেন নদিয়া জেলাতে।
৯০ এর দশকের গোড়া থেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও পূর্ব ইউরোপে দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতাদর্শের সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়। আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির স্বার্থবাহী নয়া উদার অর্থনীতির অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটে দেশ থেকে দেশান্তরে। ভারতে চালু হয় কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস কর্মসূচি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি। তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপ্লব। উত্তর আধুনিকতার দর্শন, পরিচিতি সত্তার রাজনীতি, মূল্যবোধের ভাঙন অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সূচনা করে। গোটা দেশে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনরুত্থান,রাজ্যে বিভেদকামী, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও প্রতিক্রিয়ার শক্তির আস্ফালন। এই নতুন পরিস্থিতিতে যুব সমাজের সামনে যে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ হাজির হয়, তার মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য এ রাজ্যের যুব সংগঠনকে বলিষ্ঠ নেতৃত্বদান করেন মুখ্য সংগঠক হিসেবে মানব মুখার্জি। ১৯৯৫ সালের ১৪-১৭ নভেম্বর কলকাতার নজরুল মঞ্চে ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন-এর পঞ্চম সর্বভারতীয় ভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।১৮ নভেম্বর ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রকাশ্য সমাবেশ।
ঐতিহাসিক সমাবেশ। এই সম্মেলন উপলক্ষে গঠিত অভ্যর্থনা সমিতির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন মানব মুখার্জি। যোগ্যতার সাথে। ‘সমাজতন্ত্রই ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যৎ আমাদেরই’ -এই স্লোগানকে তুলে ধরেন বলিষ্ঠ প্রত্যয়ের সাথে। নয়া উদার অর্থনীতির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে, বিভেদপন্থা ও বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে একের পর এক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গকে অখন্ড রাখার পক্ষে রক্তস্নাত ও সন্ত্রস্ত দার্জিলিংয়ে ১৯৯৩ সালের ৪-৬ এপ্রিল ডিওয়াইএফআই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কাউন্সিল অধিবেশন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সে সময়ে দার্জিলিংয়ে সমাবেশ করাটা ছিল যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয়।পশ্চিমবঙ্গে কৃষি ক্ষেত্রে অগ্রগতির পটভূমিতে নতুন পরিস্থিতিতে শিল্পায়নের সপক্ষে যুব সমাজকে শামিল করার ধারাবাহিক কর্মসূচি নেওয়া হয়। নতুন পরিস্থিতির চাহিদা পূরণের উপযোগী করে সংগঠনকে প্রস্তুত করবার জন্য নতুন স্লোগান উত্থাপিত হয় – ‘বিস্তার ঘটাও, যোগ্যতা বাড়াও।’ এই স্লোগানকে সংগঠনের অভ্যন্তরে স্ট্রিমলাইন করার কাজে নেতৃত্ব দেন। এই কঠিন সময়ে মতাদর্শ-রাজনীতি-সংগ্রাম-সংগঠন প্রতিটি ক্ষেত্রে যুব সংগঠনকে অসামান্য মুন্সিয়ানায় নেতৃত্ব দেন মানব মুখার্জি।
১৯৯৬ সালের ১৫ -১৮ ডিসেম্বর শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত ডিওয়াইএফআই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য দশম সম্মেলন থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পরেও সংগঠনের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ রক্ষা করে গেছেন। যুব সংগঠনের বাইরেও অজস্র কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে গেছেন।
সমস্ত দিক থেকেই নিজেকে তৈরি করেছিলেন। পড়াশুনোয় ছিলেন খুবই ভাল। সংস্কৃতি চর্চাতেও অগ্রসর। ছাত্র জীবন থেকেই শুরু রাজনীতি। ছাত্র সংগঠনের নেতা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক। যুব সংগঠনের কলকাতা জেলা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এবং সর্বভারতীয় নেতা। গণ-আন্দোলনের নেতা। পর পর পাঁচ বারের বিধায়ক। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রী। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষতার সুস্পষ্ট ছাপ। খুব ভাল বলতেন,অসাধারণ বিশ্লেষণ ক্ষমতা। খুব ভাল লিখতেন। লেখার ধরন একেবারেই আলাদা।অন্যরকম। তাঁর লেখা পড়তে ভাল লাগতো। অনেক লিখেছেন। তাঁর কথা শুনতে ভাল লাগতো। তাঁর ব্যবহার সবাইকে কাছে টানতো। সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি বদলায়। নতুন পরিস্থিতিতে নতুন কথা বলতে পারতেন। নতুন যুক্তি হাজির করতে পারতেন। নতুনদের মনকে ছুঁতে পারতেন সহজে। পুরনো যারা তারাও তাঁর কথা শুনে সতেজ হতে পারতেন। তাঁর রসবোধ ছিল অত্যন্ত গভীর। বেশ তীক্ষ্ম। তাইতো তিনি এত জনপ্রিয়। অনেক কিছু শিখিয়ে গেছেন। অনেক ঘটনা। অনেক কাহিনি। ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।