নয়া উদারনীতি এবং প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতির হাত ধরে উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় বড় রকমের পরিবর্তন এসেছে। উৎপাদন প্রক্রিয়াতে বিভিন্ন খন্ডে বিভিন্ন ধরনের শ্রমিককে কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। ফলে কোন একটি নির্দিষ্ট উৎপাদন ক্ষেত্রের পরিবর্তে বাড়ি বাড়ি উৎপাদনের কাজ ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। গ্রাম শহরে ছড়িয়ে রয়েছে যে বিপুল সংখ্যক বেকার, অর্ধ-বেকার, ছদ্মবেশী বেকার, তাঁরাও একে সুযোগ হিসেবেই দেখছে। বিনা মজুরিতে গৃহস্থালি কাজে আটকে থাকতে বাধ্য হন যে বিপুল সংখ্যক মহিলা, তাঁদের কাছে ঘরে বসে কাজের সুযোগ এক মস্ত বড় পাওনা। পুঁজির মালিক বা বিনিয়োগকারীর কাছে তা আরও বেশি সুযোগ। অতি সামান্য মজুরিতে বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক কাজে লাগানো সম্ভব হয় অনায়াসে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব শ্রমিকদের পক্ষে দরকষাকষির কোন সুযোগ না থাকায় শুধু কম মজুরিই নয়, বোনাস, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা মেটানোর দায় বিনিয়োগকারী এড়িয়ে যায় অবলিলায়। বহুদিনের অর্জিত অধিকারগুলিও উপেক্ষা করে চরম উদাসীনতায়। এর ফলে মজুরিসহ শ্রমিকের পাওনাগন্ডাকে অত্যন্ত নীচে আটকে রাখা সহজ হয়। শ্রমিকের জীবন ধারণের জন্য সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণের পদ্ধতিরও পরিবর্তন করা সম্ভব হয়। পরিবারের প্রায় সকলে পুরো সময় কিংবা আংশিক সময় যুক্ত হয়ে, শ্রমের সময় অনেকটা বাড়িয়ে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় রোজগার করতে বাধ্য হয়। নির্মম শোষণের এই পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় সামাজিক শ্রমের ভিত্তিতে সর্বনিম্ন মজুরি অনেকটা নীচে নামিয়ে শ্রমশক্তির প্রবাহমানতা অটুট রাখা হয়। উৎপাদন ব্যয়ে মজুরির অংশকে অনেকটা কম রেখে মুনাফা বৃদ্ধির সুযোগ বিপুল পরিমাণে বাড়ানো হয়। প্রযুক্তি ও ডিজিটাল প্লাটফর্মগুলির ওপর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি নতুন ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর ক্রমাগত আধিপত্য বিস্তার করছে। প্রযুক্তির দৌলতে ক্রেতা ও বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরির কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে । প্রযুক্তির উপর একচেটিয়া আধিপত্যকে কাজে লাগিয়ে ক্রেতা ও বিক্রেতার পছন্দগুলি জানার পাশাপাশি তাঁদের পছন্দগুলিকে গঠন ও নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ বেড়েছে।
পিসরেটে কাজ বেঁধে দেবার ফলে বাড়তি আয়ের জন্য বাড়তি সময় দিতে শ্রমিককে বাধ্য করা হয়। বাঁচার মতো মজুরির জন্য অতিরিক্ত কাজ করা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না । কাজ ছেড়ে দিলে অর্ধাহারে বা অনাহারে ডুবে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী। তাই বাধ্য হয়ে জীবনমান ধরে রাখার জন্য ক্রমাগত বেশি সময় কাজ করে যেতে হয় শ্রমিককে, শ্রমিকের পরিবারের সদস্যদের। শ্রমিকের কাজের উপর নিয়ন্ত্রণ জারি রাখার জন্য পুঁজির মালিক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে। আলগরিদমের মাধ্যমে নিয়মের জালে তাঁদের বেঁধে ফেলে। শ্রমিকদের মধ্যে সংহতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দুর্বলতার সুযোগে দরকষাকষিতে পুঁজির মালিকেরা শ্রমিকদের কোনঠাসা করতে পারে সহজে।
শ্রমিকদের মজুরিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সংহতি, ট্রেড ইউনিয়নের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের ভূমিকাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কী কেন্দ্র সরকার, কী রাজ্য সরকার গোটা দেশের উৎপাদন ক্ষেত্রে সরকারকে বিবেচনা করা হয় আদর্শ নিয়োগ কর্তা হিসেবে। নিয়োগ নীতি, কাজের শর্ত, শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি কী এটা শুধু সরকারি ক্ষেত্রে নিযুক্ত শ্রমিক কর্মচারীদের ক্ষেত্রেই নয়, অসরকারি ক্ষেত্রে কর্মরত বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের কাছেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিকে সামনে রেখে শ্রমজীবী মানুষ তাঁদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতির জন্য সংগ্রামকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
গোটা দেশে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে শ্রমজীবী মানুষের ৯৩ শতাংশ। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সরাসরি কর্মচারি সংখ্যা শ্রমজীবী মানুষের ২ শতাংশ মাত্র। সরকার যদি শ্রমিক কর্মচারিদের ন্যূনতম মজুরি অত্যন্ত নীচে রাখে, মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রকৃত আয় ধরে রাখার জন্য মহার্ঘ ভাতা না দেয় বা কম দেয়, স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা কমিয়ে অস্থায়ী ও ঠিকা শ্রমিকদের উপর ভিত্তি করে কাজ চালায়, শ্রমিকদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে , তাহলে সরকারি ক্ষেত্রের বাইরে থাকা বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের উপর তার ভয়াবহ প্রভাব পড়ে। আদর্শ নিয়োগ কর্তা সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে কাজে লাগিয়ে অসরকারি ক্ষেত্রে পুঁজির মালিকেরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অরক্ষিত শ্রমজীবী মানুষের প্রতি শোষণ ও বঞ্চনার মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক মুখপাত্র বলেছেন, রাজ্য সরকারি কর্মচারিদের ডিএ দেওয়া মানে ‘তেলা মাথায় তেল দেওয়া, এটা আমাদের সরকারের কাজ নয়।’ বুঝতে অসুবিধা হয় না, এটা সরকারি কর্মচারিদের বিরুদ্ধে অন্যান্য সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তোলার কুৎসিত অভিপ্রায় প্রকাশ। সরকারি কিংবা অসরকারি শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরির চেষ্টা অত্যন্ত বিপজ্জনক । সকলেই জানেন, ডিএ মানে বাড়তি বেতন বা মজুরি নয়। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রকৃত বেতন বা মজুরিটা ধরে রাখার জন্য যা প্রয়োজন এটা তারই একটি অংশ মাত্র। সরকারি কর্মচারিরা তেলা মাথার মানুষ নন। তাঁরা শ্রমজীবী মানুষের অংশ। তাঁদের বেতন বা মজুরিটা কোনও অনুদান বা দাক্ষিণ্য নয়। অধিকার। ডিএ বেতন বা মজুরিরই অংশ। কর্মচারিদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পরিণাম মারাত্মক। সমাজের অন্যান্য অংশের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার হরণের পথকেই তা মসৃণ করে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসহায় ও দুর্বল মানুষকে সাহায্য করাটা সরকারের দায়িত্ব। দয়া দাক্ষিণ্যের ব্যাপার না, মানুষের অধিকার হিসেবেই তা দেখা দরকার। সরকার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্পর্ক তো দাতা-গ্রহীতার নয়। সমাজের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কাজ ও অধিকার রক্ষার প্রশ্নটিকে উপেক্ষা করে, তাঁদের দুঃখ-দুর্দশার কারণ আড়াল করে কেবলমাত্র দাক্ষিণ্য বিতরণে তুষ্ট রাখার বা থাকার মানসিকতা অত্যন্ত বিপজ্জনক।
সুস্থ জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজন কাজ। সম্মানজনক মজুরি। উপযুক্ত পরিবেশ। এটা মানুষের অধিকার। সরকারি কিংবা অসরকারি ক্ষেত্রে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে বেঁচে থাকার জন্য কঠিন সংগ্রাম করছে সেই মানুষের কাজ, মজুরি ও অধিকার রক্ষার জন্য সরকার তার দায়িত্ব অবহেলা করতে পারে না। মুষ্টিমেয় পরজীবী অন্যের সম্পদ লুট করে ও উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে সম্পদের যে বিপুল ভাণ্ডার গড়ে তুলছে, তাদের লুন্ঠন ও মুনাফার মৃগয়া ক্ষেত্র সুরক্ষিত রাখাটা অর্থাৎ তেলা মাথায় তেল দেওয়াটা সরকারের কাজ হতে পারে না।