✒ স্বর্ণেন্দু সিনহা।
“আমার প্রতিবাদের ভাষা/ আমার প্রতিরোধের আগুন…….
আনে মুক্তির আলো আনে, আনে লক্ষ শত প্রাণে”
সলিল চৌধুরীর লেখা আর সুরে জিয়নকাঠি ছুঁইয়ে এই গান গেয়েছিলেন প্রবাদ প্রতিম সঙ্গীত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস ১৯৪৮ সালে। সেই সময়টা বড় গোলমেলে আর জাতীয় জীবনে অদ্ভুত সংকটময়ও বটে । একদিকে সদ্য পাওয়া স্বাধীনতার উৎসব মধুর সুগন্ধে মিশে যাচ্ছে ভাতৃঘাতী জাতি দাঙ্গার আগুনে পোড়া লাশের কটু গন্ধ অন্য দিকে শোষণের শৃংখল থেকে মুক্তির নেশায় উন্মুখ একদল মানুষের মরিয়া লড়াই আন্দোলন। গণ আন্দোলনের জনপ্রিয় ভাষ্য নির্মাণ করতে এই গান ম্যাজিকের মত কাজ করেছে। প্রতিবাদ – প্রতিরোধের ভাষা, গণ আন্দোলনের ভাষা যে এমন কাব্যিক অথচ জোরালো হতে পারে তার উদাহরণ যেকোনো ভাষাতেই বিরল।
“লাঙ্গল যাঁর – জমি তার” কিংবা “আধি নয় তেভাগা চাই” – ইত্যাদি যে সব রাজনৈতিক স্লোগানে উত্তেজিত কৃষক – কৃষক রমণী নিজেদের সম্পৃত্ত করেছিল লড়াই আন্দোলনের অভিঘাতের সাথে, নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে জোট বেঁধেছিল সেদিন বাংলায়, যে সব শ্লোগানের রাজনৈতিক তাৎপর্য পরবর্তী কয়েক দশক বাংলার রাজনীতির দিশা ঠিক করে দিয়েছে – এগুলি তার অন্যতম। তেভাগার সেই লড়াই নিয়ে গান বাঁধলেন সলিল চৌধুরী…
“হেই সামালো ধান হো
কাস্তেটা দাও শান হো
আর দেবো না আর দেবো না
রক্তে বোনা ধান মোদের ধান গো।”
গানের সুরে বিদ্রোহের আগুন জ্বললো, শিরায় শিরায় রক্তে নাচন লাগলো। জমিদার – জোতদারের লেঠেল বাহিনীর সামনে কাস্তে শানিয়ে পরিশ্রমের ফসল রক্ষার শপথ নিলেন বাংলার কৃষকেরা। এভাবেই সদ্য স্বাধীন দেশে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের কুশীলবেরা আর বাম রাজনীতির উজ্জ্বল জ্যোতিষ্করা গণ আন্দোলনের ভাষা আর দিশা ঠিক করে দিয়েছে ; যে ভাষায় দরদ ছিলো, সাধারণের মনের কথা গণ আন্দোলনের মূল স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়ার তাগিদ ছিলো।
বাম রাজনীতির সমালোচকদের অন্যতম প্রিয় বিষয় বাম রাজনীতির তাত্বিক পরিভাষার কাঠিন্য। “মার্কসীয় তত্বের জার্গণ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের বোধগম্য হয় না। সহজ ভাষায় তাকে সাধারণের বোধগম্য করে সহজভাবে উপস্থাপিত করাও সহজ কাজ নয়।” এই সমালোচনাকে পাশে সরিয়ে রেখে, শ্রেণী সংগ্রাম তত্বের “কচকচানির” মধ্যে না গিয়েও কিভাবে শ্রেণী স্বার্থকে নিজের শ্রেণী বন্ধুর কাছে জনপ্রিয় করা যায় সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের লেখা গান তার অন্যতম প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দুনিয়ার চাষা মজুর খেটে খাওয়া নিরন্ন মানুষ যে ডাকে সাড়া দিতে কুণ্ঠা বোধ করেনা, বরং একাত্ম বোধ করে সে ডাক মাঠ ঘাট বন বাঁদার উজাড় করে আসা লড়াকু মানুষের, সে ডাকে মাটির সোঁদা গন্ধ লেগে থাকে, সে ডাকে হৃদয়ে দোলা লাগে, সে ডাকে লড়াইয়ের বার্তা থাকে “জান কবুল আর মান কবুল!”
দুর্বার গণ আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখতে, জনপ্রিয় করতে সঠিক শ্লোগান নির্বাচন ভীষন জরুরি। যে শ্লোগানে সাড়া দিতে দ্বিধাবোধ করবে না, যে শ্লোগান আন্দোলনের শরিক করে নেবে সকলকে সেই শ্লোগানের ভাষা হবে সহজ আর সরল। বাম রাজনীতি বরাবর এই কাজে পারদর্শিতা দেখিয়েছে। বামপন্থীরা তাদের উদ্ভাবনী শক্তি আর ভাষার সঠিক প্রয়োগে বাংলার গণ আন্দোলনের রাশ হাতে রেখেছেন। একদল বাম তাত্বিক, মাটির সাথে যাঁদের নাড়ীর যোগ ছিলো, মানুষের মনের ভেতর যাঁদের বাস ছিলো, যাঁরা সেইসব প্রান্তিক মানুষের সুখ দুঃখের অংশীদার ছিলো, তারা বরাবর মানুষের লড়াইয়ের ভাষা যুগিয়েছেন গানে, কবিতায়, শ্লোগানে। উর্দু কবি তথা প্রথম যুগের কমিউনিস্ট নেতা হসরত মোহানি যে লবজ লিখলেন, শহীদ – এ – আজম ভগৎ সিং যে লবজ কে সারা ভারতে জনপ্রিয় করলেন তা একটা গোটা দেশের মুক্তিকামী মানুষের প্রতিবাদ প্রতিরোধের আগুন হয়ে উঠলো অচিরেই – “ইনকিলাব জিন্দাবাদ”
“পথে নেমেই পথ চেনার” সোজা সরল আহ্বানে বারেবারে সামিল হয়েছে সংগ্রামী সাথীরা। “আলোর পথযাত্রীর দল” যখন ঘরে ঘরে ডাক পাঠিয়েছে “তৈরি হওয়ার, জোট বাঁধার” তখন “মাঠে কিষান কলে মজুর নওজোয়ান” ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। জমিদার জোতদারের খুনে বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিস্পর্ধায় লড়ে গেছে। জান মাল আর জমি জঙ্গলের অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে। গণ আন্দোলনের শ্লোগানের সহজবোধ্য ভাষা এই কঠিন কাজটাকে সহজ করে দিয়েছিল সেই সময়।
গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে একটু একটু করে বদলে যেতে থাকে শ্লোগানের ভাষা। কাব্যিক মাধুর্য্য থেকে কেজো কথার ভিড় বাড়তে থাকে শ্লোগানে। গভীর রাজনৈতিক গুরুত্বের বদলে, তাৎক্ষণিক বিষয়ের ওপর ছড়া কাটা শুরু হয় এই সময় থেকেই। তবুও এই সময়েই ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমতকে সংহত করতে কলকাতা বিমানবন্দর ঘেরাও করে যুদ্ধপরাধী রবার্ট ম্যাকনেমারার বিরুদ্ধে ছাত্র ফেডারেশনের স্লোগান কালজয়ী হয়ে থাকবে। রবার্ট ম্যাকনেমারা গো ব্যাক ধ্বনির সাথে সাথে সেদিন কলকাতা আওয়াজ তুলেছিল , “তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম।” গঙ্গা আর মেকং একসূত্রে গাঁথা হয়ে যায় এক শ্লোগানে। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শ্লোগানে। আবার কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙ্গার যখন এই ষাটের দশকেই কোনো এক জনসভায় শ্লোগান তোলেন , “পুলিশ তুমি যতই মারো/মাইনে তোমার একশ বারো” তখন সময়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হওয়া পুলিশ বাহিনীকে ধিক্কার দেওয়ার জনগণের বাসনা তৃপ্ত হয় এই শ্লোগানের মধ্যে দিয়ে। সময়ের সাথে সাথে পুলিশের মাইনে হয়তো বেড়েছে কিন্তু এই শ্লোগান এখনও পুলিশের চরিত্রকে যতটা ফুটিয়ে তোলে ততটা বোধহয় হালফিলের “পুলিশ তুমি উর্দি ছাড়ো/ তৃণমূলের ঝান্ডা ধারো” পারে না।
গণ আন্দোলনে সংকীর্ণতাবাদী ঝোঁকের সূচনা সাতের দশকের একদম শুরুতে। নকশাল আন্দোলন বঙ্গ রাজনীতিকে সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে গেলেও তার ভবিষ্যত নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল সংকীর্ণতার গাড্ডায়। “বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস” কিংবা “চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান” জাতীয় শ্লোগান আলোড়ন সৃষ্টি করলেও জনমানসকে ছুঁতে পারেনি। নকশাল আন্দোলনও গণ চরিত্র লাভ করেনি। অচিরেই “বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ” মিইয়ে যায় জনসমর্থন না থাকায়।
আটের দশকের শেষ দিকে গলি গলি মে শোর হ্যায় …….. এর সাথে অন্ত্য মিল করে চোর হ্যায় শ্লোগান জনমানসে ঝড় তুলে ভোট বাক্সে ভিড় বাড়ালেও তাতে বাম রাজনীতির সেই তীব্র শ্লেষের ঝাঁজ বা আলোর দ্যুতি অনুপস্থিত ছিলো যা দিয়ে বিপক্ষকে ফালাফালা করে দেওয়ার সাথে সাথে শ্রেণী মিত্রের মন ছুঁয়ে যাওয়া যায়।
এরপর অনেকটা শূন্যতা। গত শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই লড়াই আন্দোলনের শ্লোগান ফিকে হতে থাকে। হয় পুরনো চর্বিত চর্বন নতুবা চটুল, আবেদনহীন শ্লোগান। শ্লোগানের ভাষা চয়নের ক্ষেত্রেও দুর্বলতা লক্ষ্য করা গেছে। সাময়িক চরিত্রের তাৎক্ষণিক আবেগ সঞ্জাত সেসব শ্লোগানে বাম রাজনীতির উইট অনুপস্থিত থাকলো অনেক সময়।
“মানুষই ইতিহাস রচনা করে” – প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ঋজু উচ্চারণে মানুষের ওপর আস্থা রাখার আহ্বান ছিলো। জনসভায় জ্যোতি বসুর কাটা কাটা খণ্ডিত বাক্য, সংযত উচ্চারণ আর প্রতিক্রিয়া গণ আন্দোলনের একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন তৈরি করেছিল। পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে কেন্দ্র করে মধ্যবিত্ত বাঙালির আবেগ নতুন করে আশা জাগায়েছিল। এই সময়েই তৈরি হয় নতুন শ্লোগান , “কৃষি আমাদের ভিত্তি – শিল্প আমাদের ভবিষ্যত” বাম আমলে বাংলায় কৃষির অগ্রগতিকে সংহত করে শিল্পের পথে উত্তরণের আহ্বান বহু বহু মানুষকে জুড়ে দিয়েছিল নতুন ভাবনায়। এমন জোরালো রাজনৈতিক শ্লোগান বাম গণ আন্দোলনের ফসল।
বাংলায় বাম রাজনীতির আবর্ত ছাপিয়ে সাধারণ জনমানসেও শেষ এই শ্লোগান যথেষ্ট ছাপ ফেলেছিলো সেটি হলো , “কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যত।” এই শ্লোগানের রাজনৈতিক দ্যোতনা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সাধারণ মানুষের চাহিদাকে জনপ্রিয় শ্লোগানে ঠাই দেওয়ার কাজে সফল হয়েছিল বলা বাহুল্য। পরের বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের বিপুল সাফল্য সেই কথাই বলে।
নতুন শ্লোগান নির্মাণ, শ্লোগানের জন্য ভাষা চয়নের নিরিখে গত দশক কিছুটা হতাশাজনক। “টুম্পা সোনার” প্যারোডি কিংবা বাংলাদেশের সাংসদের অনুকরণে “খেলা হবে” শ্লোগান বাংলার গণ আন্দোলনের বিপুল ঐতিহ্যের সাথে বড়ই বেমানান। চটুল বাংলা অথবা হিন্দি গানের অনুকরণে তৈরি সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টিকারী শ্লোগানে সেই ঝাঁঝ আর আবেদন কোথায়!
একুশের আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের প্রাক্কালে বাম গণ আন্দোলনের জনপ্রিয় শ্লোগান নির্মাণ নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা নতুন করে চর্চার প্রসার জরুরী। পৃথিবীর একমাত্র জাতি যাঁরা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে তাদের শিল্প সংস্কৃতি, জীবনবোধ, বিদ্রোহ আর বিপ্লবের ভাষা অনন্য হবে, সৃজনশীল হবে এটা আশা করা যেতেই পারে। সাধারণের চাওয়া পাওয়া উঠে আসবে গণ আন্দোলনের মূল স্রোতে, শ্লোগানে ঠাই পাবে মানুষের চাহিদা, শ্লোগানের ভাষা নির্বাচন হবে সহজ সরল তবেই তা বৃহত্তর পরিসরে জনমানসে আবেদন জাগায়। গণআন্দোলনকে সঠিক দিশায় চালিত করতে যা ভীষন জরুরি কাজ বিকল্প আর শক্তিশালী রাজনৈতিক ভাষ্য নির্মাণ করতে সঠিক শ্লোগান নির্বাচনের গুরুত্ব যে অপরিসীম তার বহু উদাহরণ বঙ্গ রাজনীতিতে ছড়িয়ে আছে। সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস থেকে শুরু করে হরেকৃষ্ণ কোঙ্গার, প্রমোদ দাশগুপ্ত , জ্যোতি বসু , বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য – যে সুবিশাল ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সৈনিকেরা সে ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবার গুরুদায়িত্ব নিয়েই পথ চলতে হবে আমাদের। তৃণমূল আর বিজেপির খেউড় ভরা রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদল আশু প্রয়োজন। বিজেপির “গোলি মারো” শ্লোগানে উত্তর ভারত থেকে আমদানি করা বিপক্ষকে সন্ত্রস্ত করার রাজনীতি অথবা তৃণমূলের “খেলা হবে” শ্লোগানে রাজনীতিকে নিয়ে ছেলেখেলার যে ভাবনা তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাম গণ আন্দোলনের সঠিক এবং সহজবোধ্য শ্লোগান নির্বাচন জরুরী । গণ আন্দোলনের স্বার্থেই একাজে বামপন্থীদের নেতৃত্ব দিতে হবে, বিকল্পের দিশা দেখাতে হবে। এটাই ভাষা দিবসে বাম রাজনৈতিক কর্মীদের শপথ হোক।