ডলার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত মুদ্রা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতিকে ‘ডলার কূটনীতি’ও বলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকার বিদেশ নীতির অভিমূখ নিজেদের আর্থিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের বিস্তার ঘটানো। এই লক্ষ্য সাধনের জন্য আমেরিকা নানা কর্মসূচির নাম করে বিভিন্ন রাষ্ট্রকে ঋণ দিয়ে বিশ্বের বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে এসেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা বাধাহীন ভাবে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। একমেরু বিশ্ব ব্যবস্থায় ভারসাম্য আমেরিকা নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসে। আসে নয়া উদারবাদ। বিভিন্ন দেশ বাধ্য হয় সাম্রাজ্য বাদ নির্দেশিত নয়া উদারবাদী আর্থিকনীতি গ্রহন করতে। বিভিন্ন দেশ সার্বভৌমত্ব বন্ধক দিয়ে আমেরিকার আনুগত্য মেনে নেয়। এই ঘটনার পিছনে ইউএস ডলারের বড় ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। ডলার সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে ওঠে আমেরিকা।
কিন্তু কয়েকটি প্রবনতা থেকে এ কথা কি বলা যায় ডলার আধিপত্যের অবসান ঘটতে চলেছে? আমেরিকার ডলার বিমুদ্রাকরণ বলতে বোঝায় বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, রিজার্ভ, আর্থিক লেনদেন প্রভৃতি ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরতা কমাতে চাইছে।আমেরিকার “ডলার সাম্রাজ্য “পতন প্রসঙ্গটি মূলত একটি ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিতর্কের অংশ। বর্তমানে মার্কিন ডলার আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা ও বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রধান মুদ্রা হলেও এর ভবিষ্যত অনিশ্চিয়তার মধ্যে।
ইতিমধ্যে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে আমেরিকা বিভিন্ন দেশকে ডলার ভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বাদ দিয়েছে। এদেশ গুলি আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পণ না করে বিকল্প রাস্তায় হাঁটছে।SWIFT সিষ্টেমে নিষেধাজ্ঞা বিশ্বকে বার্তা দিয়েছে -ডলার ব্যবহারের অর্থ আমেরিকার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ মেনে নেওয়া। ইতিমধ্যে চীন ও রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ইউয়ান ও রুবল ব্যবহার বাড়িয়েছে। ব্রিকস দেশগুলো নিজেদের মুদ্রায় বাণিজ্যের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সৌদি আরব,ইরান,সংযুক্ত আরব আমির শাহ তেল বিক্রয়ে ইউয়ান গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চীন ডিজিটাল ইউয়ান চালু করেছে এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনে ব্যবহার বাড়াচ্ছে। বেশ কয়েকটি দেশ ব্যাংক ডিজটাল কারেন্সি(CBDC) চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এসবের ফলে SWIFT ও ডলার নির্ভরতা কমেছে।
আমেরিকার আর্থিক অবস্থা খুব সবল অবস্থায় আছে এমনটা নয়। ঋণ সংকট বাড়ছে। ওদের ঋণ ৩৪ ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম কমেছে। ঋণের ওপর অর্থনীতির নির্ভরশীলতা অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে। কতগুলি প্রবনতা থেকে বলা যাচ্ছে ডলারের উপর আস্থা কমছে-ক্রমাগত ডেট-সিলিং সংকট, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাংকিং অস্থিরতা। এটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার হচ্ছে মার্কিনীদের একক প্রভাব কমছে, বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠছে। মার্কিনীদের ডলার আধিপত্য থেকে বিভিন্ন দেশ যে বেড়িয়ে আসছে তার প্রমান মিলছে-১) এশিয়া, আফ্রিকা, ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলি নিজেদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বাড়াতে চাইছে,২)চীন-ব্রাজিল ইউয়ান ও রিয়েল দিয়ে দ্বিপাক্ষিক লেনদেন করতে চাইছে,৩)সৌদি আরব তেল বিক্রয়ে ইউয়ান বা রুবল গ্রহণ করছে,৪) আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ ডলার ছেড়ে ইউরো ও ইউয়ান রিজার্ভে রাখা শুরু করেছে।
একক ডলার ভিত্তিক বিশ্ব থেকে বহুমুদ্রা বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠছে। যা মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। ডলারের দাদাগারি কমছে। চীনের ইউয়ান বিশ্ব বাণিজ্যে ধীরে ধীরে বাড়ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা বিশ্বের প্রবল পরাক্রমশালী অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আর্বিভূত হওয়ার পর থেকে ডলার আন্তর্জাতিক ব্যবসার জন্য প্রাথমিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসাবে থাকলেও ডলার তার আধিপত্য বহাল রাখতে পারবে কিনা সে প্রশ্ন রয়ে গেছে। ডলারমুক্তকরণ হওয়ার অর্থ বিশ্ব অর্থনীতিতে মার্কিন ডলারের প্রভাব হ্রাস পাওয়া। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকা তার আর্থিক দাপট বৃদ্ধি করার সাথে সাথে ডলারের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া তীব্র হয়।ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলারের মুদ্রার অবনতির প্রবণতা তীব্র আকার ধারন করেছিল। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অন্যান্য দেশগুলিকে বিকল্প পথ খুঁজতে বাধ্য করেছিল। বিগত কয়েক দশক ধরে বরাদ্দকৃত মুদ্রা রিজার্ভে ডলারের অংল কমেছে। বলা বাহুল্য ২০০১ সালে এটি ৭০℅ এর বেশি ছিল।
ডলারের বিকল্পগুলির মধ্যে আছে ইউরো, ইয়েন, ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং। চীন ডলারমুক্তকরণের পদক্ষেপ হিসেবে রেনমিনবিকে রিজার্ভ মুদ্রা হিসাবে স্থাপন করেছে। মার্কিন ডলার থেকে রিজার্ভের স্থানান্তরের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ অপ্রচলিত রিজার্ভ মুদ্রার দিকে চলে গেছে। এর মধ্যে আছে অষ্ট্রেলিয়ান ডলার, সুইডিশ ক্রোনা এবং দক্ষিণ কোরিয়ান ওন। ডলার আর দাদা নয়। মার্কিন শেয়ার বাজার যে কোনা সময় মূল্য হ্রাসের মুখে পড়তে পারে।
সৌদি আরব এবং ব্রাজিলের সাথে বাণিজ্যে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। স্থানীয় মুদ্রায় আন্তর্জাতিক অর্থ প্রদান করার জন্য ব্রাজিল ব্রিকসের মধ্যে সংস্কারের দিকে জোর দিচ্ছে-এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের উপর নির্ভরতা কমাবে বলেই বিশেষঞ্জরা মনে করছেন।ডলারের আধিপত্য কমবে।
১৯৪৪ সালের ব্রেটন উডস চুক্তি যুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। মার্কিন ডলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য বিশ্বের প্রাথমিক রিজার্ভ মুদ্রায় পরিণত হয়। ২০২৩ সালে বিএনএন ব্লুমবার্গ রিপোর্ট অনুযায়ী -মার্কিন ডলারের রিজার্ভ অবস্থা সাধারণভাবে স্বীকৃত তুলনায় দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর অনেক দেশ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে মার্কিন ডলার থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে থাকে। ২০২৩ সালের প্রথম দিকে আর্জেন্টিনা মার্কিন ডলারের পরিবর্তে ইউয়ান ব্যবহার করে চীনা আমদানির জন্য ব্রাজিলের সঙ্গে যোগদানের পরিকল্পনা করে। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে,চীন ও ব্রাজিল তাদের নিজ নিজ মুদ্রা ব্যবহার করে বাণিজ্য পরিচালনার জন্য একটি চুক্তি চূড়ান্ত করে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়া ও চীন তাদের দ্বিপাক্ষিক বিনিময়ে মার্কিন ডলার ব্যবহার না করার ইচ্ছা প্রকাশ করে।
আসিয়ান সদস্যভুক্ত দেশগুলি ইন্দোনেশিয়াতে আর্থিক লেনদেনে মার্কিন ডলার, ইউরো,ইয়েন ও পাউন্ড স্টার্লিংয়ের উপর নির্ভরতা কমানোর কৌশল নিয়ে আলোচনা করে। ২০২৩ সালে বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি ঘোষনা করেছিলেন -সরকার বাণিজ্য পরিচালনার জন্য মার্কিন ডলারের বিকল্প হিসাবে চীনের ইউয়ান গ্রহনের বিষয়টি বিবেচনা করছে। ২০২২ সালে ডিসেম্বরে চীন-জিসিসি শীর্ষ সম্মেলনে,চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারন সম্পাদক শি জিনপিং চীনা ইউয়ানে তেল বাণিজ্যের অর্থ প্রদান নিষ্পত্তির কথা বলেন। ২০২৩ সালের মে মাসে,চীন ৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের রাশিয়ান তেল,কয়লা এবং ধাতু কেনার জন্য ইউয়ান ব্যবহার করে।২০২২ সালের ঘানার উপরাষ্ট্রপতি মাহামুদু বাউমিয়া বলেছিলেন- তারা সোনায় তেল কেনার জন্য কাজ করছেন। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার ফল স্বরূপ ইরান মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরতা কমাতে চেষ্টা চালিয়েছে। মালয়েশিয়া মনে করে বাণিজ্যিক লেনদেনে ডলারের উপর নির্ভরশীল থাকার কোনোও কারণ নেই।
২০২২ সালের আগষ্টে তুরস্ক ও রাশিয়া প্রাকৃতিক গ্যাসের বাণিজ্য রুবেল ব্যবহার করতে সম্মত হয় । ২০২২ সালের নভেম্বরে সাইবেরিয়া হয়ে চীনে সরবরাহ করা সমস্ত গ্যাস রুবেল এবং ইউয়ানে নিষ্পত্তি করা হয়।
ব্রিকস মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরতা হ্রাস করতে চাই। সৌদি আরব তেল বাণিজ্যের জন্য ডলার-বর্হিভূত মুদ্রা ব্যবহার করতে পারে। তুরষ্ক বৈশ্বিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের নির্ভরতা কমাতে চাইছে। তুরষ্কের রাষ্ট্রপতি স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহার করে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য করার ইঙ্গিত দিয়েছে। ২০১৮ সালে ভেনেজুয়েলা ঘোষণা করে যে তারা তাদের তেলের দাম ইউরো,ইউয়ান,রুবেল ও অন্যান্য মুদ্রায় নির্ধারণ করবে।
আইএমএফ-র দেওয়া তথ্য অনুসারে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলির কাছে মার্কিন ডলারে রাখা রিজার্ভের অংশ ১৯৯৯ সালে ৭১℅ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২১ সালে ৫৯℅ এ নেমে এসেছে।২০১৬ সালের আগষ্টে,মুদ্রাস্ফীতি ৬ বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর, কাজাখাস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেছিলেন ডলারের বিমুদ্রাকরণ প্রয়োজন।২০২১সালের জুন মাসে,রাশিয়া ঘোষণা করে যে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি কমাতে তারা তাদের জাতীয় সম্পদ তহবিল থেকে ডলার বাদ দেবে। ২০২০ সালে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের অংশ ৫০℅ এর নীচে নেমে আসে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে রাশিয়া এবং ইরান মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরতা কমাতে তাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে পরিবর্তন আনে।
২০২২ সালের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য শ্রীলঙ্কা এবং মরিশাস রুপি ব্যবহার শুরু করে। ঐ বছর আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিল বাণিজ্যের জন্য একটি সাধারণ মুদ্রা প্রস্তাব করে যাকে সুর বলা হয়। ২০২৩ সালের মে মাসে ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া জাতীয় মুদ্রায় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের প্রচারের জন্য একটি সমঝোতা স্বাক্ষর করে।
২০২৩ সালে ব্রাজিলের লুলা ডলারের বিরাজমান আধিপত্যের তীব্র সমালোচনা করেন এবং ব্রিকসের মঞ্চে ভাষন দিতে গিয়ে বলেন-বৃহত্তম উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গ্রিনব্যাক প্রতিস্থাপনের জন্য একটি বিকল্প মুদ্রার সহযোগিতা ও প্রস্তাব করার আহ্বান জানান। মার্কিন ডলারের শেয়ার ব্যাপক হারে কমছে। সমস্ত প্রবনতা গুলি যোগ করলে বলা যেতে পারে,মার্কিন ডলার প্রভাবশালী বিশ্ব মুদ্রা থাকছে না।
এখন প্রশ্ন উঠছে ডলার হ্রাসের ফলে বিশ্বব্যাপী কি কোনো সুবিধা হবে। ডলার হ্রাসে বেশ কিছু বিশ্বব্যাপী সুবিধা হতে পারে। যেমন-ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি হ্রাস,মার্কিন নিষেধাঞ্জার ঝুঁকি হ্রাস,বৈচিত্র্যকরণ,আঞ্চলিক মুদ্রা শক্তিশালীকরণ,সোনার ব্যবহার বৃদ্ধি,ডিজিটাল মুদ্রার প্রচার প্রভৃতি। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ডলার বেশ কিছুটা স্থান হারিয়েছে। এই প্রবনতা বহাল থাকলে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন হবে,বিশ্ব অর্থনীতি পুনর্গঠিত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাদাগিরি কমবে। ডলার কেন্দ্রিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে দূরে সরে আসার ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি তাদের সোনার মজুদ বৃদ্ধি করবে। একটি বিকল্প আর্থিক কাঠামো তৈরি হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক আধিক্য বিস্তারের শক্তিশালী হাতিয়ার হলো মার্কিন ডলার। বিশ্ব মুদ্রাবাজারে ১৯৭২ সাল থেকে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য বজায় রেখেছে মার্কিন ডলার। কিন্তু ব্রিকস মার্কিন ডলারের বিশ্ব আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করেছে। গত বছরে ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি ৪৭℅ এ পৌঁছে গেছে। এই অনুপাত বেড়ে চলেছে। বিশ্বের জনসংখ্যার ৫৭℅ ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর অধিবাসী। আমেরিকার বিশ্ব আধিপত্য খর্ব করে ভবিষ্যতে ব্রিকস একটি ‘বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব’ গড়ে তুললে আমেরিকার আধিপত্য চূর্ণ হবে।
বিশ্ব অর্থনীতির পরিবর্তন ঘটছে এবং মার্কিন ডলারের আধিপত্যের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ ব্রিকস। ব্রিকস আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল মার্কিন ডলারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য একটি ভাগ করা মুদ্রা তৈরি করা। আজকের দিনে সারা পৃথিবীতে আলোচনার বিষয় -দুনিয়া জুড়ে শেষ হতে চলেছে ডলারের আধিপত্য? মার্কিন ডলারের জায়গা নেবে ব্রিকস মুদ্রা? তাহলে প্রতিযোগিতায় ডলার হেরে গেলে বদলে যাবে বিশ্ব অর্থনীতি?
ডলারের দাপট শেষ হলে বাড়বে সোনার ব্যবহার।১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমেরিকার ব্রিটেন উডস চুক্তি সেরে ফেলছে। সেখানে আমেরিকান ডলারকে বিশেষ মুদ্রার মর্যাদা দেওয়া হয়। ফলে দুনিয়ার রিজার্ভ মুদ্রা হয়ে যায় ওয়াশিংটনের টাকা।
২০২৩ সাল পর্যন্ত দুনিয়ার ৮০℅ খনিজ তেলের রপ্তানি হয়েছে ডলারে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ফেডারেল ব্যাঙ্কের দেওয়া তথ্য অনুসারে,১৯৯৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত উত্তর আমেরিকা মহাদেশের বাণিজ্যিক লেনদেনের ৯৬℅, এশিয়ার ৭৪℅ এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশের বাণিজ্যের ৭৯℅ ডলারের মাধ্যমে হয়েছে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আইএমএফ এর মাধ্যমে দেওয়া ঋণের ৬০℅ পরিশোধ করতে ব্যবহার হয় ডলারে।
৫০ বছর উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর ২০২৪ সালে আমেরিকার সঙ্গে নতুন করে পুনরায় ‘পেট্রোডলার’ এর চুক্তিতে আগ্রহ দেখায় নি সৌদি আরব। ধাক্কা খায় সংশ্লিষ্ট মার্কিন মুদ্রা।
গত বছর কাজান শহরে সম্মেলনে ‘ব্রিকস’ এর নতুন মুদ্রা তৈরির বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেন পুতিন। ওয়াশিংটনের কপালে ভাঁজ পড়ে। দুনিয়ার ৪০℅ খনিজ তেলের উৎপাদন করে ব্রিকস ভুক্ত দেশগুলি। চরম আতঙ্কে ট্রাম্প। মার্কিন অর্থনীতির দাদাগিরি কি বিদায় নিতে চলেছে। এমনটাই মনে করছেন আমেরিকার অর্থনীতিবিদদের অনেকে। এনিয়ে কোনো সন্দেহ নেই আমেরিকার বিদেশনীতির বিরুদ্ধে ব্রিকস ভুক্ত দেশগুলো যেভাবে এক হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে ডলারের আধিপত্য কমবে।
ট্রাম্পের খবরদারি মনোভাব অনেকেই মানতে চাইছে না। এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে এশিয়ার দেশগুলির অর্থনৈতিক পছন্দ নির্দেশ করার অধিকার আমেরিকার নেই। আমেরিকা আগেই ভারতের উপর ২৫℅ শুল্ক চাপিয়েছিল। রাশিয়া থেকে তেল আমদানির জন্য আরও ২৫% কর আরোপ করেন ট্রাম্প। ব্রাজিলের উপরও ৫০℅ কর ধার্য করা হয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে লুলা দা সিলভা ডলারের উপর নির্ভরতা কমাতে ব্রিকস বাণিজ্য মুদ্রা চালুর কথা জোরের সঙ্গে বলেছেন। একতরফা শুল্ক আরোপের পর ব্রাজিল আর শুধুমাত্র ডলারের উপর নির্ভরশীল থাকতে রাজি নয়।
মার্কিন ডলারের ভবিষ্যত অন্ধকার। বতর্মান পরিস্থিতি আসলে আমেরিকার অর্থনীতির পতন। ডলারের মৃত্যুর কাল শুরু হয়ে গিয়েছে। শুল্ক হুমকির নামে অন্য দেশের উপর জবরদোস্তি মানতে রাজি নয় চীন। একমেরু বিশ্বের বদলে বহুমেরু বিশ্বের উপস্থিতি পরিষ্কার। ন্যায় সঙ্গত বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠলে তো কোনো ক্ষতি নেই? ডি-ডলারাইজেশন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করবে।