সংঘের শতবর্ষে সংঘের বরপুত্র নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি (ঘটনা চক্রে যিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও বটে) দেশের সংবিধান (যার শপথ করে তিনি ক্ষমতায়), ধর্মনিরপেক্ষতা, ঐতিহ্য সংস্কৃতি পরম্পরা এমনকি ভারতবাসীর আবেগ জাতীয় পতাকাকে অসন্মান করলেন। সম্প্রতি দেশের মুদ্রায় আর এস এস কল্পিত ভারত মাতার মুর্তি মুদ্রিত করে তাঁর হাতে ধরিয়ে দিলে সংঘের বন্দিত ভাগওবা ঝান্ডা, আর সামনে সারিবদ্ধ স্বয়ং সেবকের দল।এই ঘটনায় প্রকৃত দেশপ্রেমিক ভারতবাসীকে আহত করেছে।
যদিও সংঘের দর্শন অনুযায়ী এই ঘটনা মোটেও বিস্ময়কর নয়, বরংচ একজন সংঘের প্রচারক হিসেবে তিনি যথার্থতার পরিচয় দিয়েছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য সংবিধান হাতে নিয়ে এমন একজন লোক দেশের প্রধান।
সংঘ বরাবরই ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় পতাকাকে অসন্মান ও অস্বীকার করেছে।তারা তিন সংখ্যাকে অপিবত্র মনে করে। দেশের সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্যের সঙ্গে সাজুর্য রেখে সংবিধান প্রনয়নের জন্য গঠিত কনস্টিট্যুয়েট অ্যাসেম্বলি জাতীয় পতাকা হিসেবে যখন তেরঙ্গাকে বেছে নেয়, আর এস এস এস দাবি করে তেরঙ্গার বদলে জাতীয় পতাকা হোক গৈরিক ভাগোওবা ঝান্ডা (অর্গানাইজার সম্পাদকীয়,১৭জুলাই,১৯৪৭)
সেদিন সংঘের ইচ্ছা পূরণ না হলেও সেই পথে যে তারা অগ্রসরমান, তার প্রমাণ ভারত মাতার হাতে সরকারী উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় মুদ্রায় দেশের জাতীয় পতাকার স্থলে ভাগোওবা ঝান্ডার মুদ্রন।যা নিশ্চিত ভাবেই জাতীয় পতাকার অবমাননা, সংবিধান এর অমর্যাদা। সংবিধানের রক্ষক দেশের সর্বোচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ জরুরি।
স্বাধীনতার আগের রাতে যখন সারা দেশ তেরঙ্গার নীচে সমবেত হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, তখন সংঘের মুখপত্র অর্গানাইজার লেখে,
“ভাগ্য বশতঃ যেসব লোক ক্ষমতায় এসেছে তারা আমাদের হাতে তেরঙ্গা ধরিয়ে দেবে। কিন্তু সেটাকে কখনোই হিন্দুরা সম্মান জানাবে না এবং নিজেদের বলে মেনে নেবে না। তিন শব্দটা অশুভ এবং একটি পতাকা পতাকা নিশ্চিয়ই স্নায়বিক প্রভাব তৈরি করবে এবং যা একটি দেশের পক্ষে ক্ষতিকর”।
এর আগে একই ভাবে শহিদের রক্তে শ্রমিক -কৃষকের ঘামে ভেজা দেশবাসীর আবেগ স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ১৫আগষ্টকে পরিবর্তনের ডাক দিয়েছে ওরা। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা জাতীয় সঙ্গীত “জন গণ মন ” পরিবর্তনের কথা বলতে কুন্ঠিত হয় নি তারা। আসলে স্বাধীনতার আগে থেকেই যারা দেশের স্বাধীনতার লড়াই থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রেখেছে, মুসলিম লীগ আর সংঘ এক যোগে বৈচিত্র্যময় ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের বিরোধিতা করেছে, যাদের অনুগামীর হাতে স্বাধীনতার পর জাতীয় জনককে খুন হন ও সংঘের উদ্যোগে মিষ্টি বিতরণ করা হয় (তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী প্যাটেলের সংঘ প্রধানকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে) তাদের রাজনৈতিক সংগঠন দেশের ক্ষমতায় এলে দেশের জাতীয় সঙ্গীত পতাকা থেকে সংবিধান পরিবর্তনে হাত দেবে এটাই বাস্তবতা।
মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সংঘ তাকে হিন্দুত্বের হৃদয় সম্রাট বলে প্রচারের ঢাকপিটিয়েছিল।সংঘের শতবর্ষে তাঁর উপর অর্পিত হয় ভারতীয় ঐতিহ্য সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময় বহুত্ববাদ আর স্বাধীনতা আন্দোলনের গৌরবময় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ দেশপ্রেমিক ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করে সংঘের হিন্দুত্বের এজেন্ডা কে কার্যকর করা।
মোদি সেই উদ্দেশ্য সফল করতে কর্পোরেট আর হিন্দুত্বের ফলায় বিদ্ধ করে দেশের মানুষকে। জীবন জীবিকার ঘোরতর সঙ্কটের সাথে দেশের ঐতিহ্য সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময় বহুত্ববাদ ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের সকল অঙ্গকে ক্ষতবিক্ষত করে চলছে হিন্দুত্বের বেলাগাম রথ।সারথী তার মোদি।
১৯৩১এর করাচি অধিবেশনে ভগৎ সিং -সুখদেব-রাজগুরুর শহিদিবরনের পরে দুই যুবনেতা সুভাষচন্দ্র বসু ও জহরলাল নেহরু দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব আনেন। একটি ছিল মৌলিক অধিকার অন্যটি তেরঙ্গা পতাকা বিষয়ে। সেই তেরঙ্গা পতাকা বিষয়ক ঘোষনায় বলা হয়েছিলো, এই তিন রঙ সমতা, স্বাধীনতা ও সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক।
পরবর্তীতে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ও মৌলিক অধিকার বিষয়ক পৃথক অংশে একে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।যা আজ আক্রান্ত।
সংবিধানের শপথ নিয়ে যিনি নিজেকে চৌকিদার বললেন,প্রতিবার স্বাধীনতা দিবসে তেরঙ্গা উত্তোলন করছেন, তিনিই আজ সংবিধান বিরোধী কাজ করছেন। মুখোশ উন্মোচিত হচ্ছে একে একে।
যে জাতীয় পতাকা হাতে প্রাণ দিয়েছেন গান্ধীজির অনুগামী গান্ধীবুড়ি নামে খ্যাত মাতঙ্গিনী হাজরা।জাতি ধর্ম বর্ণ ভাষা নির্বিশেষে শতশত শহিদের আবেগ আর রক্ত লেগে আছে যে পতাকার ইতিহাসে। যে তেরঙ্গাকে নিয়ে লেখা হয়েছে গান কবিতা।দেশের শত্রুর বিরুদ্ধে কিংবা আন্তর্জাতিক খেলার আসরে বিজয়ের বার্তায় জাতীয় পতাকা নিয়ে আন্দোলিত হয় সারা দেশ।যে সরকারের দমন পীড়নের বিরুদ্ধে জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠে প্রতিবাদের মন্ত্র, জাতীয় পতাকা হয়ে ওঠে লড়াইয়ের প্রতীক। ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন থেকে এন আর সি বিরোধী লড়াইয়ে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীকা মিছিলের অগ্রভাগে তেরঙ্গা আজাদির শ্লোগান ছড়িয়ে উচ্চ কন্ঠে জানান দেয় হাম সব ভারতীয় হ্যায়, তখন সেই জাতীয় পতাকার অবমাননা নিশ্চই ই দেশপ্রেমিক ধর্মনিরপেক্ষ দেশবাসী মেনে নেবেন না। জাতীয় পতাকার অবমাননা তো সংবিধানের মর্ম বস্তুর উপর তীব্র আঘাত।আর পিছনে ফেরার জায়গা নেই। এখন সময় এক জোট হয়ে দেশের সংবিধান,পতাকা আর দেশের মানুষকে রক্ষার সংগ্রামকে শক্তিশালী করা।