পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন ও সিপিআই (এম)- এর ভাবনা
বিভাস গুহ
পরিবেশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কিছু সম্যক ধারণা আছে। কিন্তু পরিবেশ সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা অনুধাবন করলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই পরিবেশ ও পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যাগুলি সম্পর্কে আরো বেশি সচেতন হতে পারবে। প্রত্যেক জীবই (প্রাণী ও উদ্ভিদ) একটি বিশেষ পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মধ্যে বাস করে, যার মধ্যে সে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় এবং প্রয়োজনমতো নিজেকে অভিযোজিত করে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে সামাজিক জীবন প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষ ও পরিবেশ একে অপরের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু গোটা বিশ্বে রাজনৈতিক দলগুলি এই পরিবেশ আন্দোলনকে অভিমুখীকরণের ক্ষেত্রে সর্বদা মানুষের পরিবর্তে রাজনীতিকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে, যার ফল ভুগতে হচ্ছে গোটা বিশ্বকে! বিশ্বের দরবারে উত্তর- দক্ষিণ বিতর্ক থেকে কোপেনহেগেন সম্মেলন পর্যন্ত সব পরিবেশ সম্পর্কিত সম্মেলন গুলি রাজনৈতিক আঙ্গিনায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে। তাই বিশ্ব পরিবেশকে রক্ষা করবার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পরিবেশ সম্পর্কিত নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন, চিপকো আন্দোলন বা সাইলেন্ট ভ্যালী আন্দোলন নিশ্চিতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক আন্দোলন যে অপ্রতুল সে কথা বলতেই হবে।
স্বাভাবিকভাবেই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলির কোনো কর্মসূচি আছে কিনা, তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ আবশ্যিকভাবেই আছে। রাজনৈতিক দলগুলির কর্মসূচিতে পরিবেশ এবং পরিবেশগত সমস্যাকে গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে গোটা দেশে অন্যান্য জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনায় সিপিআই(এম) -র ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সিপিআই(এম) মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক দল। ফলে পরিবেশ সম্পর্কে দার্শনিক মার্কস -এর চিন্তাভাবনার পরিসর পরিবেশ রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবেশ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে “কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো” তে (১৮৪৮ সাল) মার্কস – এঙ্গেলস লিখেছিলেন, “আধিপত্যের এক শতাব্দী পূর্ণ হতে না হতেই বুর্জোয়া শ্রেণী যে উৎপাদন শক্তি সৃষ্টি করেছে, তা অতীতের সকল যুগের সমষ্টিগত উৎপাদন শক্তির চেয়েও বিশাল ও অতিকায়। প্রকৃতির শক্তিকে মানুষের কর্তৃত্বাধীন করা, যন্ত্রের ব্যবহার, শিল্প ও কৃষিতে রাসায়নিক প্রয়োগ, বাষ্পশক্তির সাহায্যে জলযাত্রা, রেলপথ, চাষবাসের জন্য নদীর খাত কাটা ভেলকিবাজির মতো যেন মাটি ফুঁড়ে জনসমষ্টির আবির্ভাব সামাজিক শ্রমের কোলে যে এতখানি উৎপাদন শক্তি সুপ্ত ছিল, আগেকার কোন শতক তার কল্পনাটুকুও করতে পেরেছিল?” ফলে বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের যুগেও মার্কসের পরিবেশ চিন্তার নৈর্ব্যক্তিক ধারণা প্রবল ভাবেই প্রাসঙ্গিক। মার্কসের ভাবনার মতই প্রকৃতি , পরিবেশ, সমাজ ও ব্যক্তি মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কসমূহকে সামগ্রিকতার প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করার পদ্ধতিগত যথার্থতা আজও বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়।
মার্কসীয় দর্শনে প্রভাবিত সিপিআই(এম ) তাদের রাজনৈতিক দলিলে গুরুত্ব সহকারে পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা বারে বারে আলোচনা করেছে। পরিবেশ গত সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি পরিবেশ আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দেবার চেষ্টা করেছে সিপিআই(এম)। নিম্নে উল্লেখিত কয়েকটি পার্টি কংগ্রেসের রিপোর্ট, তা বারে বারে প্রমাণ করে। পরিবেশ প্রসঙ্গে, সিপিআই(এম) সপ্তদশ পাটি কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাবে (১৯-২০ মার্চ,২০০২, হায়দ্রাবাদ) “অন্যান্য ক্ষেত্রে উদারীকরণের প্রভাব” অংশে বলেছে — “উদারীকরণ, পরিবেশগত অবনতির সমস্যাকে তীব্র করেছে। ভূমিক্ষয়, বায়ু দূষণ, জল দূষণ, জনসাধারণের জীবনযাত্রা ও উন্নতির উপর প্রভাব ফেলেছে। ….. বহনীয় উন্নয়নের স্বার্থে জনমুখী উন্নয়নের কাজগুলি পরিবেশগত ধারণাকে রেখেই করতে হবে।”
কয়েক বছর বাদেই উনবিংশতিতম তম পার্টি কংগ্রেসের (২৯ মার্চ – ৩ এপ্রিল, ২০০৮, কোয়েম্বাটুর) রাজনৈতিক প্রস্তাবে “পরিবেশ সম্পর্কিত বিষয় সমূহ” প্রচ্ছদের ২.৭১ অনুচ্ছেদে সিপিআই(এম) উল্লেখ করেছে, “ভারতে পরিবেশগত সমস্যা, গুরুতর আকার ধারণ করেছে এবং বিভিন্ন এলাকায় সংকটের গভীরতা ক্রমশ বাড়ছে। এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনযাত্রা, জীবন ধারণের মান এবং স্বাস্থ্যের উপর ; বিশেষত: গরিব ও প্রান্তিক জনগণের মাঝে এই সমস্যাগুলো আরও প্রকট হয়ে উঠেছে উদারীকরণ ও বিশ্বায়নের ফলে।” ২.৭৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “……. পরিবেশ রক্ষা করার জন্য রাজ্যগুলির উচিত তাদের সংশ্লিষ্ট আইনগুলির কঠোর প্রয়োগ সুনিশ্চিত করা।” ফলে এই কথা বলা যেতেই পারে, উদারীকরণের প্রভাব ও পরিবেশগত সমস্যা একে অন্যের সাথে সম্পর্ক যুক্ত। শুধুমাত্র রাজনীতি নয়, পরিবেশগত রাজনীতির অভিক্ষাও প্রতিফলিত হয়েছে এই অনুচ্ছেদগুলিতে। ২.৭৪ অনুচ্ছেদে প্রাসঙ্গিকভাবেই গোটা বিশ্বে আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন ও গ্রিন হাউস গ্যাসের সমস্যার আলোচনা পরিবেশ রাজনীতিকে ” ইস্যু” করার ক্ষেত্রে সিপিআই (এম) কে বিশ্ব রাজনীতিতে আরো প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
বিংশতিতম সিপিআই(এম) কংগ্রেসে (১৭ – ২০ জানুয়ারি, ২০১২, কলকাতা) “জলবায়ুর পরিবর্তন” শীর্ষক প্রচ্ছদের ১.৩৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ১৯ তম পাটি কংগ্রেস লক্ষ্য করেছিল, জলবায়ু পরিবর্তন ও গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন যদি প্রতিহত না করা যায়, তাহলে তা পৃথিবীর পক্ষে কি বিপদজনক পরিণতি আনতে পারে ? বিশ্ব ধনতন্ত্রের লুটেরা ও অর্থনৈতিক চরিত্রের পরিণতি জলবায়ু সংকট। ………উন্নত দেশগুলি জলবায়ু সংকটের জন্য মুখ্যতঃ দায়ী হলেও, এর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হবে উন্নয়নশীল দেশ এবং বিশ্বের গরিবদের”। ১.৩৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “কিয়োটো প্রোটোকলে স্থির হয়েছিল, উন্নত দেশগুলি ১৯৯০-এর তুলনায় ২০০৮ – ১২ তে নির্গমন ৫.২ শতাংশ কমিয়ে আনবে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যায় এবং প্রোটোকল অনুমোদনই করেনি। তাদের নির্গমন বাস্তবে ১৭ শতাংশ বেড়ে গেছে। ভারতের মাথাপিছু নির্গমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ ভাগের এক ভাগ। ১.৩৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “কোপেনহেগেন থেকে ডারবান, পরপর জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বজুড়ে নির্গমন নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করেছে। মাথা পিছু নির্গমনে সমতার নীতিকে লঘু করেছে। ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী বাধ্যতামূলক দায়বদ্ধতার ব্যবস্থার জন্য আলোচনায় সমতাকেই মুখ্য দাবি করতে ভারতের উচিত জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে অবস্থান পুন:বিন্যস্ত করা। দুনিয়া জুড়ে প্রগতিশীল অংশের উচিত ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করা এবং নিজ নিজ দেশের সরকারের উপরে চাপ তৈরি করা, যাতে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ফলপ্রসু ও সমতামূলক চুক্তিতে উন্নীত হওয়া যায়।
২১ তম পার্টি কংগ্রেসে ( ১৪ – ১৯ এপ্রিল,২০১৫, বিশাখাপত্তনম) “জলবায়ু পরিবর্তন” প্রচ্ছদে বিশ্ব পরিবেশ সমস্যার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রধানত দায়ী করা হয়েছিলো। উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিলো যে, ঐ বছরের ডিসেম্বরে প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব পরিবেশ শীর্ষক বৈঠকে মার্কিনীদের নেতৃত্বে কিয়োটো প্রোটোকলের পরিবর্তে নতুন কোন চুক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। একই সঙ্গে আগামী কয়েক বছরে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলে তিন থেকে চার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা সম্পর্কেও বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিলো। ২২ তম রাজনৈতিক প্রস্তাবে (১৮ – ২২ এপ্রিল, ২০১৮, হায়দ্রাবাদ) “শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ” শীর্ষকে এবং পরবর্তীতে ২০২২ সালে ২৩ তম কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাবে “প্রাকৃতিক সম্পদ লুট ও পরিবেশ” শীর্ষক অংশে বর্তমানে দেশের সরকার দ্বারা দুর্বল পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ও সরকারি ব্যবস্থাপনার ওপরে গুরুতর আক্রমণ নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। পরিবেশগত পরিস্থিতিকে লঘু করে কর্পোরেট ও ধনীদের স্বার্থবাহী উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে পরিবেশগত আন্দোলনকে আরো বৃহত্তর পরিসরে আনার উদ্যোগ নেবার কথা বলা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এ কথা অনস্বীকার্য যে, সি.পি.আই(এম) দল সামাজিক সমস্যার পাশাপাশি পরিবেশগত সমস্যা নিয়েও বিশেষভাবে চিন্তিত। পরিবেশ সমস্যার পাশাপাশি পরিবেশ আন্দোলনের অভিমুখ চিহ্নিত করেছে এই রাজনৈতিক দলটি। পরিবেশকে আংশিকভাবে বিচার করে কখনোই এর বহুমাত্রিকতাকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয় । সামগ্রিকতার নিরিখেই পরিবেশ এবং পরিবেশগত আন্দোলনকে বিচার করতে হবে। পরিবেশগত সমস্যা যে মানুষের অন্যতম সামাজিক সমস্যা এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্র সমস্যা তা মানুষকে আরো বেশি করে অবগত করানোই রাজনৈতিক দলগুলির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হওয়া উচিত। আর গোটা দেশে এই আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিতে হবে সি.পি.আই(এম) কে।