চিরস্মরণীয়
🖋 সুপ্রতীপ রায়
১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব একটি দর্শনের বিজয়।শোষক শ্রেনীর সমস্ত ধরনের অপপ্রচার ও কুৎসার জবাব দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।আজ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নেই এটা ঠিক। নভেম্বর বিপ্লব দেশে দেশে সমাজতন্ত্র ও স্বাধীনতার শক্তির উন্মেষ ঘটাতে সহায়ক হয়েছিল। কিন্তু মানব সভ্যতায় সোভিয়েতের অবদান চিরস্মরণীয়। ফ্যাসিবাদী বর্বরতা থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেছিল ; ভারতবর্ষ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম জয়ী হওয়ার পিছনে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার অবদান মুছে ফেলা কখনই সম্ভব হবে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিষ্টদের পরাজিত করা সম্ভব না হলে মানব সভ্যতার সামনে নেমে আসত চরম বিপর্যয়। ফ্যাসিবাদের পরাজয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন গৌরবময় ভূমিকা গ্রহন করেছিল। লালফৌজকে সামনে রেখে ফ্যাসিবাদকে পরাভূত করতে সামনের সাড়িতে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্টরা, গণতান্ত্রিক মানুষ।
পৃথিবীর ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা নভেম্বর বিপ্লব। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করার জন্য জন্মের পর থেকেই চেষ্টা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্যাসিষ্টদের মূল টার্গেট ছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে প্রথম থেকেই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্বক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল। রণাঙ্গনে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্টদের।হিটলার বাহিনীকে পরাস্ত করতে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল লালফৌজ বাহিনী।
একথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত মুহূর্তেও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির একটি অংশের ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল। দ্বিতীয় রণাঙ্গন খুলতে টালবাহানা না করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার এত বিপুল ক্ষতি হতো না ; যদিও শেষ পর্যন্ত হিটলার বাহিনীর পরাজয় ঘটে, রাইখ্ষ্টাকে লাল ঝান্ডা ওড়ে। নভেম্বর বিপ্লবের পর বিংশ শতাব্দীতে এটি ছিল দ্বিতীয় বহত্তম ঘটনা বললে অত্যুক্তি হবে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের পরাজয় না ঘটলে গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যেতো, ধ্বংস হয়ে যেতো মানব সভ্যতা, বিলুপ্ত হতো পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট সম্পদগুলি।আজ সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকলেও উজ্জ্বল অক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে তার আত্মত্যাগের কাহিনী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। দু’কোটি মানুষ জীবন দিয়েছিলেন। ফ্যাসিবাদের যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দিতে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন বিপুল পরিমাণ ক্ষতি স্বীকার করেছিল।
হিটলার ছিলেন একেবারে সাধারণ পরিবারের। তবে ছিল জোরালো কন্ঠ। ইহুদি ঘৃণা, গণতন্ত্র বিরোধিতা ছিল ওঁর পুঁজি। রাশিয়া আক্রমন করে হিটলার ভেবেছিল, কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সমস্ত পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য দেশগুলি তার সহযোগী হবে ; যদিও ঘৃনিত হিটলারকে শেষ পর্যন্ত আত্মঘাতী হতে হয়, সহযোগীদের ফাঁসিতে ঝুলতে হয়। সভ্যতার জায়গায় বর্বরতা কায়েম হলে তার পতন অনিবার্য — এটাই সমাজবিজ্ঞানের নিয়ম।হিটলারের ক্ষেত্রে তারও ব্যতিক্রম ঘটেনি। আর এ পতনকে অনিবার্য করেছিল লালফৌজ।
১৯৪১ সালের ২২জুন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতি বদলে যায়। কলকাতা টাউন হলের এক জনসভা থেকে গঠিত হয় “সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি”।ঐবছর ২০জুলাই সমিতির উদ্যোগে বাঙলার বিশিষ্ট শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের একটি বিবৃতি প্রচারিত হয়। এই বিবৃতি থেকে মানবকল্যাণে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবদান প্রকাশিত হয়েছিল। বিবৃতিটি নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
“সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নাৎসি আক্রমণ পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করিয়াছে।বিশাল রণক্ষেত্র জুড়িয়া আজ যন্ত্র ও মানুষের তান্ডব চলিতেছে; ব্যাপকতায় এ যুদ্ধ অভূতপূর্ব। এই সঙ্কটকালে আমরা মনে করি, নৈতিক ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপুল কীর্তির প্রতি সর্বসাধারণের মনোযোগ আকর্ষণ করা একান্ত কর্তব্য।আমরা কেহ কেহ কেহ কেহ সোভিয়েত শাসনের কোন কোনো বিষয়ের বিরুদ্ধে সমালোচনা করিয়া থাকি; কেহ কেহ মার্কসবাদ সমর্থনও করি না। কিন্তু জার আমলের কুশাসনের যে কুৎসিত উত্তরাধিকার সোভিয়েত ইউনিয়নকে গ্রহণ করিতে হইয়াছিল এবং তারপর সদ্যোজাত সোভিয়েতের বিরুদ্ধে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রের যে মারাত্মক আক্রমন চলিয়াছিল তাহা স্মরণ করা যায়, তখন সোভিয়েতের বর্তমান কীর্তিকে মুক্তকন্ঠে প্রশংসা না করিয়া থাকা যায় না। রবীন্দ্রনাথ উহার উচ্ছসিত প্রশংসা করিয়াছেন।”
আধুনিক জগতের দুইজন প্রধান সমাজতত্ত্ববিদ্ — সিডনি ও বীটরিস্ ওয়েব –তাঁহাদের “সোভিয়েত কমিউনিজম– এক নতুন সভ্যতা” (Soviet Commuism — A New Civilisation) নামক পুস্তক প্রকাশ করার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্বন্ধে প্রচুর নির্ভরযোগ্য তথ্য সকলের গোচরে আসিয়াছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নে সমস্ত কারখানা, খনি, রেলওয়ে জাহাজ, জমি ও ব্যবসায় জনসাধারণের সম্পত্তি। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন সকলের মঙ্গলের জন্য পরিকল্পিত — কয়েকজন লোকের মুনাফার জন্য নয়। যাহারা সমাজতান্ত্রিক মতবাদের সমর্থক নয়, সোভিয়েত পরিকল্পনা তাহাদিগকেও অনুরক্ত করে। সেখানে শিক্ষার সমান সুযোগ সার্বজনীন; প্রত্যেককে সতেরো বৎসর বয়স পর্যন্ত স্কুলে পড়িতে হয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ সরকারী ব্যয়ে অধ্যয়ন করে।সকলের জন্য কাজের ব্যবস্থা আছে; সোভিয়েত ইউনিয়নে কেহ বেকার নাই। অন্য সমস্ত স্থানে বারবার যে অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দিয়া থাকে, সেখানে তাহা লুপ্ত হইয়াছে।সর্বাধিক খাটুনির সময় দিনে আট ঘন্টা; গড়ে তাহা সাত ঘন্টার কম। সকলের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। শ্রমিকরা পীড়িত অবস্থায় পুরো মজুরি পায়; এতদ্ব্যতীত তাহারা প্রতি বৎসর বেতনসহ ছুটি পায়।সোভিয়েত ইউনিয়নে নারী ও শিশুর যেরূপ যত্ন লওয়া হয়, জগতে আর কোথাও সেরূপ লওয়া হয় না। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকগনই এইসব কথা স্বীকার করিয়াছেন।
সোভিয়েত পরিকল্পনা গুলি যে কার্য সাধনে প্রয়াসী, কোনো প্রাচীন বা আধুনিক রাষ্ট্র, এপর্যন্ত সে কাজে হাত দেয় নাই; এই পরিকল্পনাগুলি ব্যাপকতায় যেমন বিরাট, তেমনই বাস্তব প্রয়োগোপযোগী ও বিজ্ঞান সম্মত।
সিডনি ও বীট্ রিস ওয়েব বলিয়াছেন, “আমাদের মনে হয়, এমন দেশ নাই যেখানে সমভাবে তত্ত্ব ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সরকারী অর্থ ব্যয়ে এতবেশি ও এত বিচিত্র বৈঞ্জানিক গবেষণা চলিতেছে। মুনাফালোভী প্রবৃত্তির ফলে বিজ্ঞান যেভাবে ব্যর্থ হইতেছে, সে সম্বন্ধে ব্রিটিশ ও আমেরিকান বৈঞ্জানিকরা এখন অনুযোগ করিতেছেন। একথা অন্তত নি:সন্দেহে বলা যায় যে, এখানে (সোভিয়েত দেশে) সে ব্যর্থতার সুযোগ একরকম নাই।”
জার সরকার অন্যান্য প্রধান রাষ্ট্রের সহযোগে এশিয়ার দেশসমূহে যে সকল অন্যায় সুবিধা ভোগ করিত, বিপ্লবের পর সোভিয়েত সে সুবিধা এক কথায় ছাড়িয়া দেয়; আমরা ভারতবাসীরা ইহা ভুলিতে পারি না। বহু জাতিকে ও কোটি কোটি লোককে জার শাসন ইচ্ছাপূর্বক ‘অনুন্নত’ করিয়া রাখিয়াছিল, কিন্তু সোভিয়েতের জাতিগত ও ভাষাগত স্বাধীনতা প্রত্যেকের উৎকৃষ্ট সংষ্কৃতিকে বিকশিত করিয়াছে। যেখানে একদিন কুসংষ্কার ও ধর্মতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ার রাজত্ব ছিল, সেখানে আজ এক নতুন মানস-জীবনের সঞ্চার হইয়াছে। কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৮৫টি জাতি ও ১৪৭টি ভাষার মধ্যের কোনো একটা বিশেষ জাতি বা ভাষার কৃত্রিম প্রাধান্য নাই।মুসলমান রাষ্ট্রের মধ্যে নারীমুক্তির প্রথম আইন প্রবর্তিত হয় সোভিয়েত ‘আজের বাইজানে’, কামালের তুরস্কে নয়। বুখরা রাজ্যের সহিত আধুনিক সোভিয়েত ‘উজবেকিস্তানের’ পার্থক্য কি বিপুল! বুখরায় ছিল আট হাজার ওঝা এবং আমীর, তাহার হারেম ও তাহার দরবারের জন্য মাত্র একজন ডাক্তার।
ওয়েব দম্পতি লিখিয়াছিলেন, “সোভিয়েত ইউনিয়ন অনগ্রসর জাতিগুলিকে শুধু যে সমান অধিকার দিয়াছে তাহা নয়, পরন্তু তাহাদের অনুন্নত অবস্থার জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী দারিদ্র্য, অত্যাচার ও দাসত্ব দায়ী : ইহা স্বীকার করিয়া তাহাদের শিক্ষা ও সামাজিক উন্নতি, শ্রম শিল্পের উন্নত ও কৃষি সংষ্কার বাবদ উন্নত জাতিগুলি অপেক্ষা মাথা পিছু বেশি ব্যয় সরকারী তহবিল হইতে বরাদ্দ করিয়াছে।”সোভিয়েত ইউনিয়নে পুস্তক প্রকাশের সংখ্যাও বিপুল। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রকাশিত পুস্তকের সংখ্যা একত্রে ইংল্যান্ড, জার্মানি ও জাপান অপেক্ষা বেশি ছিল।নাৎসি নির্বাসিতসোভিয়েত ইউনিয়নে পুস্তক প্রকাশের সংখ্যাও বিপুল। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রকাশিত পুস্তকের সংখ্যা একত্রে ইংল্যান্ড, জার্মানি ও জাপান অপেক্ষা বেশি ছিল।
নাৎসি নির্বাসিত আইনষ্টাইনের পুস্তক সম্ভবত অন্য যে কোন দেশ অপেক্ষা সোভিয়েত ইউনিয়নে বেশি বিক্রি হয়, ১৯২৭ ও ১৯৩৬ সালের মধ্যে তাঁহার গ্রন্থ ৫৫,০০০ খন্ড সেখানে বিক্রি হয়। শেক্সপীয়ারের ৩৭৫তম জন্মবার্ষিকী তাহার স্বদেশে অলক্ষিত থাকিলেও, সোভিয়েত ইউনিয়নে সর্বত্র শ্রমিক ও কৃষকগণ তাঁহার জন্মবার্ষিকী পালন অনুষ্ঠিত করে। ১৯৩৯ সালের বসন্তকালে মস্কোতে প্রায় দুই লক্ষ লোক ‘কিং লীয়ার’ অভিনয় দেখে। ক্ষুদ্র আর্মেনিয়া রাষ্ট্রে গত পাঁচ বৎসরে শেক্সপীয়রের গ্রন্থ ৩২,০০০ খন্ড বিক্রয় হয়।
আমরা যে অর্থে বুঝি, সে অর্থে সোভিয়েতের জনসাধারণের মধ্যে কোনও সংষ্কৃতিবান শ্রেনী নাই; তাহারা উহা চাহেও না। তাঁহারা চাহে সমগ্র জাতিকে সংষ্কৃতিবান করিতে। তাহারা সকলকে অবকাশ, নির্বিঘ্নতা ও সুযোগ দিতে চায়।
কুড়ি বৎসরের প্রবল বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নের জনসাধারণ এক নতুন সভ্যতার সৃষ্টি করিয়াছে। সেই সভ্যতা যখন বিপদাপন্ন, তখন আমরা বহু যুগব্যাপী অন্নাভাবে জীর্ন হীনতায় নিমজ্জিত ভারতবাসীরা নিরুদ্বিগ্ন থাকিতে পারি না। আমরা অসহায় ও পরাধীন ; তথাপি সোভিয়েতে অন্তত আমাদের শুভকামনা অামরা প্রেরণ করিতে পারি। সোভিয়েত ইউনিয়ন যেদিন তাহার বিরুদ্ধে শক্তি পুঞ্জকে পরাভূত করিয়া আপনাকে সুপ্রতিষ্ঠা করিবে, সেই দিনের জন্য আমরা অপেক্ষা করিয়া থাকিব।
(স্বা:)আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সাহিত্যিক ও শিল্পী প্রমথ চৌধুরী, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, যামিনী রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রজনীকান্ত দাস, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, হিরণকুমার সান্যাল, নীরেন্দ্র রায়, গোপাল হালদার, আবু সৈয়দ আয়ুব, আব্দুল কাদের, সমর সেন, বিনয় ঘোষ, অজিত চক্রবর্তী, বিমলা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য। হাইকোর্ট, বার লাইব্রেরি অরুণ সেন, অবনী ব্যানার্জি, সুকুমার মিত্র, মি:এন এস মালেহজি, এস কে আচার্য, জ্যোতি বসু। অধ্যাপক নির্মল ভট্টাচার্য, সুশীল দত্ত (স্কটিশ চার্চ কলেজ), আনন্দকৃষ্ণ সিংহ, বিজয়কুমার রায়, সতীশ চন্দ্র সেনগুপ্ত, ভবতোষ দত্ত, নন্দলাল ঘোষ (রিপন কলেজ), এন এন সেনগুপ্ত, করুনাময় মুখোপাধ্যায় (বঙ্গবাসী কলেজ), প্রভাসচন্দ্র ঘোষ (বিদ্যাসাগর কলেজ), অমরেন্দ্র প্রসাদ মিত্র (ভিক্টৌরিয়া ইনষ্টিউশন)। সাংবাদিক হেমচন্দ্র নাগ (সম্পাদক, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড), বঙ্কিমচন্দ্র সেন (সম্পাদক, দেশ), সত্যেন্দ্র নাথ মজুমদার, মৃণালকান্তি বসু (অমৃতবাজার পত্রিকা), বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় (সম্পাদক, যুগান্তর), অমল হোম (সম্পাদক, মিউনিসপ্যাল গেজেট), জ্যোতিষ ভৌমিক (সম্পাদক, ফরোয়ার্ড), এ আর মলিহাবাদী (সম্পাদক, রোজনা হিন্দ)। অধ্যক্ষ রবীন্দ্রনারায়ন ঘোষ (রিপন কলেজ), প্রশান্তকুমার বসু (বঙ্গবাসী কলেজ), বীরেশ চন্দ্র গূহ (বিজ্ঞান কলেজ)। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কালিদাস নাগ, অমিয়কুমার সেন, নারায়ণ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ত্রিপুরারি চক্রবর্তী, এন কে সিংহ, হুমায়ুন কবীর, নীহার রঞ্জন রায়, বটকৃষ্ণ ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, এল পি সুকুল, এ বি এন হবিবুল্লা, ধীরেন্দ্রনাথ সেন, পি সি গুপ্ত, হরিচরণ ঘোষ, রেণু রায়, নিখিল চক্রবর্তী, সরসীকুমার সরস্বতী।
উপরিউক্ত বিবৃতি থেকে প্রমাণিত হয় কেমন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি এই মূল্যায়নে উপনীত হয়েছিল — এই যুদ্ধ কেবল মাত্র সোভিয়েত জনগনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয় ; এই যুদ্ধে ফ্যাসিষ্ট বাহিনী জিতলে ফ্যাসিস্ত সাম্রাজ্যবাদ পদাতন উপনিবেশগুলিতে নতুন ধরনের সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শোষন কায়েম করবে, ধ্বংস হবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।একারণে ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক মুক্তিযুদ্ধের চরিত্রে রূপান্তরিত করার আহ্বান জানিয়ে ছিলেন কমরেড স্তালিন।
১৯৪১ সালের ২২ জুন হিটলারের ফ্যাসিষ্ট বাহিনী রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর আক্রমন নামিয়ে আনে। স্তালিনের নেতৃত্বে লালফৌজ যুদ্ধে সঠিক রণকৌশল গ্রহন করে।লাল ফৌজের নীতি ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধে জনগনকে অনুপ্রাণিত করেছিল। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি ও তার নেতা স্তালিনের সঠিক নেতৃত্বে লাল ফৌজের বাস্তবোচিত রণকৌশলের ফলেই অল্প সময়ের মধ্যেই (মস্কো অবরোধের আগেই) ১৮হাজার শত্রু সেনা নিহত হয়, ২৯টি যুদ্ধ জাহাজ ভূপাতিত হয়, ২২২টি জার্মান ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়। ১৯৪৫ সালের ১মে সোভিয়েত লাল ফৌজ ও মিত্রবাহিনীর কাছে হিটলার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ৯মে সম্মিলিত মিত্র বাহিনীর কাছে জার্মান বাহিনীর সর্বাধিনায়ক উইলহেলম্ কাইটেল আত্মসমর্পণ করেন। শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
বিশ্বকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিচক্ষনতা,দুরদৃষ্টির কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরাধীন দেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এক নতুন স্তরে উন্নীত হয়েছিল। আসলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয় ছিল স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের বিজয়। লাল ফৌজ বাহিনী ফ্যাসিস্ত বাহিনীর আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত সাহসিকতার এবং নিখুঁত ভাবে ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে।
ফ্যাসিবিরোধী ঐতিহাসিক যুক্তফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানালেও, সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কাছে এ বিশ্লেষন ছিল – এই ফ্রন্ট গঠনের মধ্যে দিয়ে মিত্র শক্তির মধ্যে দিয়ে যে শ্রেণী দ্বন্দ্ব আছে তার সমাপ্তি ঘটবে। দ্বিতীয় ফ্রন্ট গঠনের প্রশ্নে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মিত্রশক্তির (বিশেষ ব্রিটেন এবং আমেরিকার) তীব্র মতানৈক্য দেখা দিয়েছিল।
১৯৪১ সালের শেষদিকে স্তালিন সঠিকভাবেই অনুধাবন করেছিলেন, একক ফ্রন্টের উপর নির্ভর করে যুদ্ধে জেতা যাবে না। ১৯৪১সালের ৬ নভেম্বর সোভিয়েত জনগনের উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে বলেছিলেন, “লাল ফৌজকে যে একের পর এক পশ্চাদপসরন করতে হচ্ছে তার অন্যতম কারণ হলো ইউরোপীয় ভূখন্ডে জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ফ্রন্টের অনুসস্থিতি।আরো বাস্তব ঘটনা হলো, এই মুহুর্তে ইউরোপীয় মহাদেশে জার্মান ফ্যাসিস্ত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য গ্রেট ব্রিটেন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন সৈন্যবাহিনী নেই। এজন্য জার্মান বাহিনী তাদের সমস্ত শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নকে লক্ষ্য করেই সৈন্য মোতায়েন করছে। ইউরোপের বুকে জার্মানের মিত্রশক্তি সোভিয়েতকে লক্ষ্য করেই তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। বর্তমান পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্য হলো যে, সোভিয়েত লালফৌজকে এককভাবে লড়তে হচ্ছে জার্মান, ফিনল্যান্ড, রোমানিয়া, ইতালি এবং হাঙ্গেরির সম্মিলিত ফ্যাসিস্ত বাহিনীর বিরুদ্ধে।”
১৯৪২ সালের ৬ নভেম্বর স্তালিন দ্বিতীয়বারের জন্য দ্বিতীয় ফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং এই আহ্বানকে কার্যকরী করার জন্য সেই সময়কার সোভিয়েত কমিশনার ফর ফরেন এফেয়ার্স মলোটভকে ওয়িশিংটন ও ব্রিটেনে পাঠান।মলৌটভ লন্ডনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষনা করেন, দ্বিতীয় ফ্রন্ট গঠনের প্রশ্নে আমেরিকা ও ব্রিটিশ সরকারের চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে ; কিন্তু মলোটভ লন্ডন ছাড়ার পর চার্চিল ও রুজভেল্ট পৃথক পৃথক ভাবে ঘোষনা করেন, তাঁদের পক্ষে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলা সম্ভব হচ্ছে না। তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে স্তালিন আমেরিকা ও ব্রিটেন সরকারের কাছে তারবার্তা পাঠান। ১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে তেহেরানে এক বৈঠকে স্তালিন, চার্চিল, রুজভেল্ট মিলিত হয়েছিলেন ১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসে মস্কোতে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলা নিয়ে স্তালিন, চার্চিল, রুজভেল্ট পুনরায় বৈঠকে বসেন। বৈঠকে রুজভেল্ট ও চার্চিল দ্বিতীয় ফ্রন্টের পরিবর্তে ভলকান পরিকল্পনার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই পরিকল্পনার নির্যাস ছিল ➖ মিত্রবাহিনীর জার্মান ফ্যাসিষ্টদের প্রতিরোধের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভলকান অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে লাল ফৌজ যাতে অবস্থান না করতে পারে! স্তালিন এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন এবং দ্বিতীয় ফ্রন্ট ব্যাতীত অন্য কোনো প্রস্তাব আলোচিত হলে স্তালিন বৈঠক ছেড়ে চলে যাবেন বলে ঘোষনা করেন।
শেষপর্যন্ত আমেরিকা, ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দ্বিতীয় ফ্রন্ট গঠিত হয় (১৯৪৪ সালের জুন)। লাল ফৌজের পিছনে সমগ্র সোভিয়েত জনগণ সমবেত হয়েছিলেন। কারখানার শ্রমিক থেকে কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত সবাই ছিলেন এই যুদ্ধের সৈনিক।লাল ফৌজ যে দক্ষতা অর্জন করেছিল তা বোঝা যায় ১৯৪২ সালের ৪ফেব্রুয়ারি জার্মান বাহিনী মস্কোয় পরাজিত হওয়ার পর স্তালিনের ঘোষনা থেকে।স্তালিন ঘোষনা করে ছিলেন, “যে দক্ষতা নিয়ে জার্মান ফ্যাসিস্ত শক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করে আকস্মিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমন করেছিল, জার্মান ফ্যাসিস্ত বাহিনী সেই দক্ষতা হারিয়ে ফেলেছে।আজ লাল ফৌজের দক্ষতা ফ্যাসিস্ত বাহিনী অপেক্ষা অনেক বেশি। লাল ফৌজের নিরবচ্ছিন্ন আক্রমন হানার ক্ষমতা, মুক্ত অঞ্চলকে রক্ষা করার ক্ষমতা, ডিভিসনগুলির গুণগতমান, সৈন্যদের নৈতিক চেতনা এবং সর্বোপরি নির্দেশ দেবার সুনিপুন কৌশল লালফৌজকে বিশ্বের অন্যতম সুশৃঙ্খল এবং শক্তিশালী ফৌজে রূপান্তরিত করেছে। “ফ্যাসিস্ত সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমতকে সংগঠিত করেছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ত বাহিনীর পরাজয় না ঘটলে ইতিহাসের গতি কুপথে ধাবিত হতো। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন কেবল মাত্র নিজের দেশকে রক্ষা করেনি সে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখিয়েছে পৃথিবীতে ‘শান্তি চায় সমাজতন্ত্র’। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, ‘সাম্রাজ্যবাদ চায় যুদ্ধ’। মতাদর্শগতভাবে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াই পরিচালনার বিষয়টি লঘু করার মনোভাব আসলে আত্মঘাতী মনোভাব।