"সত্যিই কি গান্ধীজী ব্রিটিশ শাসকের কাছে সাভারকারকে ক্ষমা ভিক্ষা করে চিঠি লিখতে বলেছিলেন ?"
আশীষ চক্রবর্ত্তী
আরএসএস এবং বিজেপি’র পক্ষ থেকে একটা কথা প্রায়ই প্রচার করা হয় “সাভারকার মহাত্মা গান্ধীজীর কথায় ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে চিঠি দিয়েছিলেন।” আমাদের দেশের বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অন্যতম প্রধান “স্বয়ংসেবক” রাজনাথ সিং আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের উপস্থিতিতে গত ১২ ই অক্টোবর ২০২১ দিল্লীর আম্বেদকর আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে রূপা পাবলিকেশনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত উদয় মাহুরকর এবং চিরায়ু পন্ডিতের ইংরাজী ভাষায় লেখা একটি বই— “Veer Savarkar : The Man Who Could Have Prevented Partition” (বাংলায় মানে করলে দাঁড়ায়—–“বীর সাভারকার : যে মানুষটি দেশভাগ রোধ করতে পারতেন”) প্রকাশনার অনুষ্ঠানে ঐ একই কথা বলেন -“It was on Mahatma Gandhi’s suggestion that Savarkar filed mercy petition to the British.” রাজনাথ সিং এর মন্তব্য থেকে দুটো বিষয় খুবই পরিষ্কার। প্রথমত, তিনি স্বীকার করেছেন সাভারকার ক্ষমা প্রার্থনা করে ব্রিটিশ সরকারের কাছে তাঁর মুক্তির জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী এই ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনটি সাভারকার গান্ধীজীর কথায় করেছিলেন।
এই বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করবার জন্য একবার ইতিহাসের পাতায় লেখা প্রকৃত ঘটনার দিকে একটু আলোকপাত করা যাক।
বস্তুত বিজেপি দলে জাতীয় কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট পার্টির মতো প্রকৃত কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামী নেই। ছিল বিশ্বাসঘাতক। স্বাধীনতা সংগ্রামে আরএসএস যে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষ নিয়েছিল এই সত্যটা গোপন করা তাদের পক্ষে খুবই জরুরী। আন্দামান সেলুলার জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় সাভারকার নিজের মুক্তি চেয়ে মোট পাঁচবার ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন দলিল দস্তাবেজে তার অনেক প্রমাণ আছে। আরএসএস, বিজেপি এবং স্বয়ং রাজনাথ সিং বলছেন গান্ধীজীর পরামর্শেই নাকি সাভারকার ইংরেজ সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়েছিলেন। সাভারকার ইংরেজ সরকারের কাছে প্রথম ক্ষমা ভিক্ষা করেন ১৯১১ সালে। ১৯১১ সালের ৪ঠা জুলাই তাঁকে আন্দামান সেলুলার জেলে আনা হয়। জেলে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই তিনি ব্রিটিশ সরকারকে চিঠি লেখেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯০৯ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এবং কালেকটার এ এম টি জ্যাকসনকে এক প্রেক্ষাগৃহে সশস্ত্র বিপ্লবী অনন্ত কানহেরে গুলি করে হত্যা করেন। পরবর্তীকালে পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে কানহেরে যে পিস্তল (ব্রাউনিং পিস্তল) দিয়ে জ্যাকসনকে হত্যা করেন সেটি এসেছিল সাভারকারের কাছ থেকে। একই সঙ্গে পুলিশ কানহেরে এবং তাঁর বিপ্লবী সহকর্মীদের ধড়পাকড় করে তাঁদের কাছ থেকে সাভারকারের লেখা বেশ কিছু চিঠি উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিল। সাভারকার তখন দেশে ছিলেন না। ফিউজিটিভ অফেন্ডার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী সাভারকারকে গ্রেপ্তার করে ভারতে নিয়ে আসার জন্য ওয়ারেন্ট জারি হয়। সাভারকার সে সময় প্যারিসে থাকা সত্ত্বেও ১৯১০ সালের ১৩ ই মার্চ লন্ডনে ফিরে এসে কোন এক অজ্ঞাত কারণে স্বেচ্ছায় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। ১৯১০ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর বিচারের রায় বেরোলো। সাভারকারকে দোষী সাব্যস্ত করে আন্দামান সেলুলার জেলে পাঠানো হয় এবং সেই সঙ্গে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্তও করা হয়। এই রায় বেরোনের কয়েকদিনের মধ্যে ১৯১১ সালের ২৩ শে জানুয়ারি জ্যাকসন হত্যায় সাহায্য করার অভিযোগ এনে নতুন একটি মামলা সরকার রুজু করলো। এক সপ্তাহের মধ্যেই নিষ্পত্তি হয়ে গেল এই মামলার। বিচারকের রায়ে পঞ্চাশ বছরের জন্য সাভারকারের আন্দামানে দীপান্তরের আদেশ হলো। বছর শেষ না হতেই সাভারকার ব্রিটিশ সরকারের কাছে মার্জনা ভিক্ষা করে এক আবেদননামা পেশ করলেন। মূল আবেদননামাটি পাওয়া যায় নি। কিন্তু এই চিঠির উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁরই লেখা ১৯১৩ সালের ১৪ ই নভেম্বর ক্ষমা ভিক্ষা প্রার্থনা করে লেখা দ্বিতীয় চিঠিতে। সেখানে তিনি লেখেন, “আপনাকে আমি সবিনয় স্মরণ করে দিতে চাই, ১৯১১ সালের পাঠানো মার্জনা পত্রে আমি উল্লেখ করেছি সরকার আমাকে যে দায়িত্ব দেবে, আমি সেই দায়িত্ব নিয়েই সরকারের সেবা করতে প্রস্তুত। সরকারের পিতৃসম দুয়ার ছাড়া এই উড়নচন্ডী সন্তান (prodigal son) কোথায়-ই বা যেতে পারে?” এই আবেদনের উপসংহারে সাভারকার লিখলেন, “ভারতের রাজনীতির হালের ঘটনাগুলি এবং ভারত সরকারের বন্ধুত্বপূর্ণ আপোস – আলোচনার নীতি আর একবার সাংবিধানিক রীতি প্রথা মেনে চলার সুযোগ করে দিয়েছে। ১৯০৬-১৯০৭ সালে ভারতে যে উত্তেজক ও নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, তা আমাদের বিভ্রান্ত করে শান্তি ও প্রগতির পথ থেকে সরিয়ে কন্টকাকীর্ণ পথে নিয়ে গিয়েছিল। আন্তরিকভাবে ভারত ও মানবজাতির কল্যাণ কামনা করে এমন কোন মানুষই বর্তমানে অন্ধের মত সেই পথ অনুসরণ করবে না। সুতরাং সরকার যদি সর্বপ্রকারের দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শন করে আমাকে মুক্তি দেন, তাহলে আমার চেয়ে আন্তরিকভাবে কেউই আইন মেনে চলতে এবং ইংরেজ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন দেখাতে পারবে না। এই আনুগত্যই আইন মেনে চলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।” সাভারকার ১৯১৪ সালে ক্ষমা ভিক্ষা করে তৃতীয় চিঠি দেন ব্রিটিশ সরকারকে।
বিজেপি – আরএসএস নেতৃত্বের, একবার বিপ্লবী যতীন দাস (যিনি টানা ৬৩ দিন অনশন করে মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন), ভগৎ সিং কিংবা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য সশস্ত্র বিপ্লবীদের জীবনী পাঠ করা উচিত। পাঠ করা উচিত তদানীন্তন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের কথা — যাঁরা অনেকেই আন্দামান সেলুলার জেলে ব্রিটিশদের অবর্ননীয় অত্যাচার সহ্য করেছেন ; কিন্তু নিজের মুক্তির জন্য কখনও ক্ষমা ভিক্ষা করার কথা কল্পনাও করতে পারেন নি।
মহাত্মা গান্ধী ১৯১৫ সালে ভারতে আসেন এবং ঐ বছরই স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। তার আগে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলেন। তাহলে গান্ধীজী এমন পরামর্শ সাভারকারকে দিলেন কেমন করে, যিনি দেশেই ছিলেন না? একথাও আমরা সবাই জানি গান্ধীজী নিজে ১১ বার জেলে গিয়েছিলেন। কিন্তু একবারও কি নিজের মুক্তির জন্য ইংরেজ সরকারের কাছে ক্ষমা চেয়ে মুচলেকা দিয়েছিলেন? দেননি। কারন ক্ষমা চাওয়া ছিল তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের বিরুদ্ধে। ১৯১৭ সালে সাভারকার চতুর্থ বারের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করে চিঠি দেন ব্রিটিশ সরকারকে। ১৯২০ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে সাভারকারের তৃতীয় ভ্রাতা নারায়নরাও দামোদর সাভারকার গান্ধীজীর কাছে একটি চিঠি লিখে কারাবন্দী “বীর” (!) সাভারকার ও তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গণেশ দামোদর সাভারকারকে (ওরফে বাবুরাও সাভারকার) কিভাবে মুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ দেবার অনুরোধ করেন। এই চিঠির উত্তরে গান্ধীজী লেখেন, “আপনার চিঠি আমি পেয়েছি। এই বিষয়ে আপনাকে পরামর্শ দেওয়া খুবই কঠিন কাজ। তবে আমার মনে হয়, আপনি একটি আবেদন পত্র লিখতে পারেন, যাতে সংশ্লিষ্ট সমস্ত তথ্য দেওয়া থাকবে এবং সে তথ্য থেকে স্পষ্ট হবে যে, আপনার ভাই যে অপরাধটি করেছেন, সেটি পুরোপুরি রাজনৈতিক।” এই চিঠিতে গান্ধীজী আরো লিখলেন, “যাঁদের বিরুদ্ধে হিংসায় যুক্ত থাকার প্রমাণ নেই, তাঁদের ছেড়ে দেওয়া উচিত।” এই চিঠির বয়ান গান্ধী রচনাবলীর সপ্তদশ খন্ডে পাওয়া যাবে। কিন্তু সাভারকারের বিরুদ্ধে হিংসার প্রমাণ ছিল এবং সাভারকার নিজেই স্বীকার করেছেন নিজের ভুল। ইংরেজ সরকারের কাছে পাঠানো তাঁর ক্ষমা ভিক্ষার আবেদনগুলিতেই তার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯২০ সালের ২৫ শে জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকারের প্রতি সাভারকারের লেখা পঞ্চম এবং শেষ চিঠিতে তিনি লিখলেন, “আমাকে মুক্তি দিলে আমি আজীবন ব্রিটিশ রাজের প্রতি আমার নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন করবো। আজীবন আপনাদের স্বার্থে কাজ করে যাবো। আমি ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শক্তির একজন স্বার্থবাহী ব্যক্তি। আমি এবং আমার ভাই এই অঙ্গীকার করতেও রাজি যে আমরা সরকার নির্ধারিত একটা নিদিষ্ট ও যুক্তিসংগত সময়সীমা পর্যন্ত রাজনীতিতে অংশ নেব না। আমরা জেল থেকে ছাড়া পাবার পর একটা নির্দিষ্ট প্রদেশের বাইরে যাব না এবং আমাদের গতিবিধি পুলিশকে নিয়মিতভাবে জানাবো। আমরা আন্তরিকভাবেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার অঙ্গীকার করছি এবং আমি ও আমার ভাই তা মেনে চলবো।”
ব্রিটিশ শক্তির কাছে সাভারকারের এই হীন, নিঃশর্ত ও সাষ্টাঙ্গ আত্মসমর্পণ ঐতিহাসিকভাবে প্রমানিত সত্য। রাজনাথ সিং -রা যতই চেষ্টা করুন সাভারকারের কলঙ্কময় জীবন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করার, কখনই তা করতে পারবেন না — করা সম্ভবও নয়! সাভারকার নিজেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সম্পূর্ণ এক বিপ্রতীপ অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন। সাভারকারই হিন্দু মহাসভার সভাপতি থাকাকালীন ১৯৩৫ সালে প্রথম হিন্দু ও মুসলিমদের সম্পূর্ণ আলাদা জাতি হিসাবে বর্ণনা করেন। অবিভক্ত ভারতবর্ষে দ্বিজাতি তত্ত্বের জনক আর কেউ নন স্বয়ং বিনায়ক দামোদর সাভারকার। ১৯২৪ সালে জেল থেকে মুক্তি পাবার পর প্রতিশ্রুতি মতো তিনি ব্রিটিশ রাজের সেবা করে গেছেন। ১৯২৫ সালে আরএসএস গঠন করার ক্ষেত্রেও ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ মদত ছিল। সাভারকার প্রচারিত ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ অনুযায়ী “ভারতমাতার সন্তান হিসাবে শুধুমাত্র তাঁদেরই গন্য করা হবে, যাঁদের ‘পিতৃভূমি’ এবং ‘পূন্যভূমি’ এক এবং অভিন্নভাবে ভারতবর্ষ।” এই তত্ত্ব অনুযায়ী ভারতবর্ষকে এক হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যাতে মুসলিম এবং খ্রীষ্টানরা এদেশের নাগরিক হিসাবে কার্যত অস্বীকৃত হন, কারণ ভারতে জন্ম নিলেও তাঁদের ‘পূন্যভূমি’ ভারতে অবস্থিত নয়। এই মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই নাথুরাম গডসে সাভারকারেরই পরামর্শে জাতির জনক গান্ধীজীকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। সাক্ষ্য-প্রমানের অভাবে সাভারকার মুক্তি পেয়েছিলেন। আসলে সাভারকারকে নির্দোষ এবং একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক বানাতে গিয়ে আরএসএস বা রাজনাথ সিংয়েরা জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর আদর্শকেই বারবার হত্যা করছেন। আরএসএস প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করে প্রমাণ করতে চায় তারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক। আর সেই জন্যই গান্ধীজীকে নিয়েও মিথ্যাচার করতে তারা বিন্দুমাত্র কুন্ঠা বোধ করে না।
লেখক পরিচিতিঃ সিপিআই(এম) চাকদহ এরিয়া কমিটির সদস্য, পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক।
তথ্যসূত্রঃ
(১) হিন্দু জাতীয়তাবাদঃ একটি ইতিবৃত্ত
লেখকঃ শ্যামাপ্রসাদ বসু
(২) Hindutva: Savarkar Unmasked
Writer: Shamsul Islam
(৩) The Men Who Killed Gandhi:
Writer: Manohar Malgonkar
(৪) হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিবর্তন
লেখকঃ ড. গৌতম রায়