সেদিন কোন্ পক্ষ ছিল জানি না! তবে দেবীপক্ষ নয় নিশ্চিত ; কামদুনির ছোট্ট মেয়েটাকে যেদিন পাশবিক উল্লাসে শেষ করে দেওয়া হলো, তারপর অনেকগুলো দেবীপক্ষ এসেছে, গিয়েছে।উৎসব মুখরিত হয়েছি আমরা। কারোর মনে আছে, আবার কারোর নেই। এমনটাই তো হয়! স্মৃতিকে অহেতুক কষ্ট দিতে, কে চাই বলুন ? যা গেছে তা যাক, ছোট্ট ঘটনা ➖ তিনি তো বলেই দিয়েছেন কতদিন আগে! আমাদের বাংলায় উৎসবের একটা লোকায়ত ঘরানা আছে, এখানে শাস্ত্র পুরান কোরানের চেয়ে মানুষের সহজিয়া ভাবই উৎসবের মূল অনুষঙ্গ। কঠিন অজানা শব্দে মন্ত্র ধ্বনি প্রতিবার অষ্টমীতে উচ্চারণ করার পরেও “অতসী পুষ্পাভ্যাং …. ” আমার মা পিসিদের মুখস্থ ছিল না, মানেটাও সবটা জানতেন না, অথচ “যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী, উমা আমার বড় কেঁদেছে, “রেডিওতে শুনে আমার দিদিমা চোখের জলে ভাসাতেন। আমার মায়ের মতো অনেকেরই এই গান মুখস্থ ছিল।
দেবীস্ত্রোত্র এর চেয়ে রামপ্রসাদ – কমলাকান্ত -নজরুলের আগমনী বিজয়া গানেই মাতোয়ারা হতো শরতের আকাশ, দোলা লাগতো কাশের গুচ্ছে। কে হিসেব রাখতো ? “দনুজদলনী ..গান মুসলমানের লেখা। এখানে দেবী উমা ঘরের মেয়ে। এখন চারিদিকে শিবকে রুদ্র বানানো হচ্ছে, সেই শিব পাগলা ভোলা জামাতা। তাকে নিয়ে কত রঙ রস। “মেনকা মাথায় দেরে ঘোমটা…. জামাই হলো ল্যাঙটা রে ল্যাঙটা..!!” দেবাদিদেবকে নিয়ে এমন রঙ্গ রসিকতা করা, কিংবা পটচিত্রে তার ঐরকম মোটকা নাদুস -নুদুস (আজকের কার্টুন সদৃশ) ছবি আঁকার সাহস বাঙালিই পারে। কবি শেখর কালিদাস রায় যথার্থ বলেছেন “মানুষই দেবতা গড়ে, তাহার কৃপার প’রে করে দেবমহিমা নির্ভর” দুর্গা শিব কালী মনসা নিয়ে যেসব প্রচলিত গল্প গাঁথা, তার কোন কিছুই দৈবকাহিনি না, বাঙালির পারিবারিক জীবনের গল্প। সেখানে রাগ অভিমান, সুখ দুঃখ দারিদ্র্যের বারোমাস্যা রয়েছে। ঝগড়া বিবাদও আছে। মনসা দুর্গার ঝগড়া, বিমাতা দুর্গা মনসার চোখে কাঠি ঢুকিয়ে কানা করা, মনসার পদাঘাতে উমার মাজায় আঘাত, বিয়ের আসরে ধুনোর গন্ধে শিব ঠাকুরের সাপের কোমরবন্ধ (বেল্ট) খুলে সে কী লজ্জাজনক কান্ড! যে দেবীর কাছে আমরা ধনং দেহী বলবো, তিনিই আবার নদিয়ার জলঙ্গী পারের ঈশ্বরীপাটনীকে তার দারিদ্র্য, সতীনের জ্বালা, বৃদ্ধ স্বামীর কথা বলেন। মালদার হিন্দু -মুসলমান লোকশিল্পী পাগলা ভোলাকে নিয়ে গম্ভীরার সুরে নৃত্য পাগল হয়ে ওঠেন।
পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীর আগমনকে বাঙালি মা তার কন্যার আগমনের অনুষঙ্গে দেখেন।
এখনো ঘরে ঘরে সপুত্র কন্যা বাপের বাড়ি যান বাঙালি গৃহবধূরা। বাঙালি মা – মেয়ের চিরন্তন মিলন উৎসব। কামদুনির কন্যাহারা এমন স্বপ্ন ই দেখতেন, কিন্তু উৎসবের আলো জ্বলার আগেই সেই স্বপ্ন চিরতরে নিভে গেল। কামদুনির ভায়ের ভাইফোটা মুছে গেল। তবুও তারা চোখের জ্বল মুছে দিনগুনতো অপরাধীরা সাজা পাবে, যারা তাদের মেয়ে বোনকে নৃশংস পাশবিক উল্লাসে শেষ করে দিল, তাদের যোগ্য শাস্তি হবে, যা দেখে আগামীকালের ভাবী অপরাধীরা শিউরে উঠবে।কিন্তু এবারের দেবীপক্ষ এর আগে বিচার এর ফলাফল ঘোষণা হলো, নাম মাত্র শাস্তি আর বেকসুর খালাস, বিচারালয় বললেন, পুলিশ আর সরকারের উপযুক্ত প্রমানের অভাবে এই রায়! সকলেই বুঝতে পারলেন কামদুনির রায় কাদের অনুপ্রেরণায়, যাদের অনুপ্রেরণা ছাড়া এরাজ্যের গাছের পাতা নড়ে না, টয়লেটের শিলান্যাস হয়না, পুজো প্যান্ডেল এর প্রবেশদ্বার উন্মোচন করা যায় না, যাদের অনুপ্রেরণায় মাটি বালি কয়লা চাকরি থেকে গণতন্ত্র সবটাই চুরি হয়।
অথচ আমরা নির্লজ্জের মতো কামদুনির লজ্জা থেকে মুখ সরিয়ে নারী শক্তির আরাধনা করবো, যাদের অনুপ্রেরণায় বাংলার নারীধর্ষকরা ছাড়া পাবে, তাদের দিয়ে পুজোর উদ্বোধন করাবো, ঢাকের তালে ভুলে কামদুনির মায়ের চোখের জল, এ রাজ্যের লাখো লাখো চাকরি হারা যুবক যুবতীর রাতজাগা কাহিনি।
উৎসব মানে তো আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সারা, সকলের তরে সকলে আমরার অনুভব।অথচ আমরা কেমন ভুলে যাচ্ছি, এদেশ সবচেয়ে অভুক্ত মানুষের দেশ, অপুষ্টির দেশ, এরাজ্যের পাটচাষী ছহাজার টাকা খরচ করে পাট লাগিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল পাট বেচে ছেলে বউয়ের পরনে নতুন জামা কাপড় দেবে, এখন উৎসবের মরশুমে সেই পাটের দাম সাড়ে তিন হাজার। যে ছেলে বা মেয়েটি স্বপ্ন দেখেছিল লেখা পড়া শিখে চাকরি পেয়ে মা বাবাকে কাপড় জামা কিনে দেবে, বান্ধবী তার উপহার দেওয়া চুরিদার পরে তার বাইকের পেছনে বসে প্যান্ডেল হকিং করবে, মা তার বোনাসের টাকায় কেনা গরদের শাড়ি পড়ে মন্ডপে অঞ্জলি দেবেন।সেই সব স্বপ্ন কটা বছরেই চুরমার। অথচ দেবীপক্ষের আগেই অসম্পূর্ণ প্যান্ডেলে তিনি বাড়ি থেকে উদ্বোধন করে বিশ্ব রেকর্ড করলেন। টিভিতে যেসব নেতাদের ঘুষ খেতে দেখেছেন, তাদেরই কয়েকজন জেলে থাকলেও বাকিরা স্বমহিমায় উৎসবের কেষ্ট বিষ্টু, কেউবা বান্ধবীকে নিয়ে নতুন পোষাকে ফটোশপ করছেন। অথচ যে ছেলেটি বা মেয়েটি নির্ভেজাল ভালো বেসেছিল, একটা যোগ্য চাকরির জন্য সে কলকাতার রাজপথে উৎসবের বাহারি আলোর শহরে ফুটপাত রাত জাগবে।
যার কারখানার ফিতে কাটার কথা, তিনি সিঙুর ভেঙেছেন, যার কৃষকের পাটের দাম ঠিক করে দেওয়ার কর, শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার কথা তিনি প্যান্ডেলের ফিতে কাটছেন, চোখ আঁকছেন, ভুলভাল মন্ত্র উচ্চারণ করছেন, বেসুরো গান গাইছেন।
আপনি উৎসবে আনন্দ মুখরিত হোন ক্ষতি নেই, কিন্তু একটু ভাবুন, আগামীর কথা ভাবুন। উৎসবের উঠোনে সম্প্রীতির রোদ ছড়িয়ে পড়ুক, সকলের মুখে হাসি ফোটানোর আগামীর জন্য শপথ হোক উৎসবের মঙ্গল বার্তা।