হাতিয়ারে দিতে হবে শান
বাদল দত্ত
‘সব চেয়ে কম খেয়ে,কম পড়ে,কম শিখে, বাকি সকলের পরিচর্যা করে; সকলের চেয়ে বেশি তাদের পরিশ্রম সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান। কথায় কথায় তারা রোগে মরে, উপোসে মরে, উপরওয়ালাদের লাথি ঝাঁটা খেয়ে মরে- জীবনযাত্রার জন্য যত কিছু সুযোগসুবিধে সব কিছুর থেকেই তারা বঞ্চিত।… অধিকাংশ মানুষকে তলিয়ে রেখে, অমানুষ করে রেখে, তবেই সভ্যতা সমুচ্চ থাকবে,একথা অনিবার্য বলে মেনে নিতে গেলে মনে ধিক্কার আসে।'(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাশিয়ার চিঠি, ১৯৩০)।
তারপর কতদিন তো হয়ে গেল, পৃথিবী তো অনেক বদলেছে।বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব আবিষ্কার হয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে গেছে। সম্পদের বিপুল ভান্ডার তৈরি হয়েছে। কিন্তু তলাকার মানুষের, শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন হয়েছে কতটুকু? এইতো সেদিন ইকোনমিক পলিসি ইনস্টিটিউট জানালো, ১৯৭৯ থেকে ২০২১ এর মধ্যে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে ৬২ শতাংশ। আর মজুরি বেড়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ। যতটা সম্পদ বেড়েছে, ততটা শ্রমজীবী মানুষের আয় বাড়েনি। যারা ধনী, তারা আরও ধনী হয়েছে। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে অশ্লীলভাবে।এটা আমেরিকার হিসেব।
আমাদের দেশের হালচাল আরও খারাপ।গোটা বিশ্বে ৮২ কোটি মানুষ প্রতি রাতে ঘুমোতে যায় খিদের যন্ত্রণা নিয়ে। এর মধ্যে ভারতে রয়েছে ২২ কোটি মানুষ, যা গোটা বিশ্বের অপুষ্টিতে আক্রান্ত মানুষের প্রায় ২৫শতাংশ।[রাষ্ট্রসঙ্ঘের ফুড এন্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন (ফাও)-র রিপোর্ট, ২০২২]। অনাহারের কারণ যতটা না উৎপাদনে ঘাটতি , তার চাইতে অনেক বেশি বন্টনে অসাম্য। শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার তো ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে। খাদ্যাভাবে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে। একদিকে ধনীদের হাতে বিপুল পরিমাণের সম্পদ বেড়েই চলেছে।মহামারির দিনগুলিতে বেড়েছে অতি দ্রুতহারে।অন্যদিকে রোজগারহীন, অপুষ্টিতে ভোগা ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ক্ষুধার সূচকে ভারত ক্রমশ নিচে নামছে। ১১৬ টি দেশের মধ্যে এখন ১০৭-এ। গত বছর ছিল ১০১ এ। প্রতিবেশী দেশগুলি থেকেও ভারতের অবস্থা খারাপ। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০২২সালে ভারতে যক্ষায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে ৬.৬ শতাংশ হারে।[বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র রিপোর্ট]। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও), ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন এর যৌথ সমীক্ষার ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ প্রকাশিত ফলে দেখা যাচ্ছে যে, ২০২১ সালের শেষে বলপূর্বক শ্রম দিতে বাধ্য করা হয়েছে ২ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষকে এবং বলপূর্বক বিয়েতে বাধ্য করা হয়েছে ২ কোটি ২০ লক্ষ মানুষকে। গত পাঁচ বছরে এটা বেড়েছে ২৫ শতাংশ। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব,মহিলা ও শিশুরা। বিশ্বে বলপূর্বক বিয়ের ঘটনাগুলির দুই তৃতীয়াংশই ঘটেছে সর্বাধিক জনাকীর্ণ প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলে। মেয়েদের অবস্থা তো ভয়াবহ। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ২০২০ সালের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিগত পঞ্চাশ বছরে বিশ্বে ১৪ কোটি ২৬ লক্ষ হারিয়ে যাওয়া মেয়ে-র (‘মিসিং উইমেন’- অমর্ত্য সেন) মধ্যে প্রায় ৪ কোটি ৬০ লক্ষ মেয়েই ভারতের। আর হিসেব বাড়িয়ে লাভ নেই। আমাদের দেশের সরকার তো এসব হিসেব-নিকেশ কিছুই মানতে চায় না।আমাদের দেশে এতদিন ধরে যে সমস্ত তথ্য ও পরিসংখ্যান কেন্দ্রগুলি সুনামের সঙ্গে কাজ করছিল, সেগুলি তো সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। তথ্য গোপন করে, বিকৃত তথ্য পরিবেশন করার মরিয়া প্রচেষ্টা সত্বেও সত্যকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। প্রকৃত সত্যকে আড়াল করলে, প্রকৃত পরিস্থিতি যথাযথ উপলব্ধি করা দায়িত্ব অস্বীকার করলে পরিস্থিতির বদল-ঘটানোর কর্মসূচি আসতে পারে না। গোটা দেশ, সমাজ অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়াটাই ভবিতব্য হয়ে দাঁড়ায়। প্রায় একশো বছর আগে অসাম্যের পরিস্থিতিকে মেনে নিতে রবীন্দ্রনাথের মনে ‘ধিক্কার’ এসেছিল,আজ একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে বড় রকমের পরিবর্তনের পরও ভয়াবহ অসাম্যে আমাদের মন কি এতটুকু বিচলিত হবে না?
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দেশ গুলিতে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর যারা গলা ফুলিয়ে বলার চেষ্টা করে গেছেন পুঁজিবাদই শেষ কথা, এটি সভ্যতার শেষ অধ্যায়, তাদের মন বিচলিত হওয়ার কোন কারণ নেই। তারা একই সাথে একথা মনে করছেন যে, শোষণ ও বঞ্চনাই আমাদের ভবিতব্য । এটা সবাইকে মেনে নিতে হবে। তার জন্য মনোজগতে উপনিবেশ তৈরি করার অভিযান চালানো দরকার জোর কদমে। তার বিস্তার আয়োজন চলছে সর্বত্র।
কিন্তু যাদের মনে ‘ধিক্কার’ আসে,যারা এ অন্যায়-অবিচার-বৈষম্যকে মেনে নিতে চান না, যারা বিকল্প সমাজের জন্য সন্ধান করতে চান, তারা কিছুতেই পুঁজিবাদকে শেষ অধ্যায় বলে মেনে নিতে পারেন না। তাদের সামনে বিকল্পের আলো জ্বেলেছিল নভেম্বর বিপ্লব। নভেম্বর বিপ্লব যে সোভিয়েতের ইউনিয়নের জন্ম দিয়েছিল,সে সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন আর বেঁচে নেই। কিন্তু সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন গোটা পৃথিবীর সামনে যে শিক্ষা রেখে গেছে তাকে কিছুতেই মুছে ফেলা যাবে না। বেকারি-দারিদ্র্য-বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সমস্ত দিক থেকে গোটা সমাজকে এগিয়ে যাওয়ার নতুন পথের সন্ধান দিয়ে গেছে । ফ্যাসিবাদের পরাজয় সুনিশ্চিত করে বিশ্বের শান্তি ও গণতন্ত্রকে রক্ষা ও প্রসারিত করা, বিশ্বের দেশে দেশে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দিশা দেখিয়ে গেছে।
আবার এটাও অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন একটি মস্ত বড় বিপর্যয়। নভেম্বর বিপ্লবের বার্তা যেমন করে গোটা বিশ্বকে আলোড়িত করেছিল, মুক্তির লড়াইয়ে শ্রমজীবী মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল,তেমনি করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও সমাজতন্ত্রের বিজয়ও গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়ে গেছে। মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে এত বড় সাফল্য সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন কেন ঘটল, সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় কেন হল? যারা পুঁজিবাদের পূজারী, তারা তো সমাজতন্ত্র অচল, মার্কসবাদ সেকেলে, পুঁজিবাদই শেষ কথা – এসব বলেই খালাস।পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পৌনঃপুনিক সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার কোন পথ কিছুতেই তারা খুঁজে পাচ্ছে না। বিকল্প সন্ধানী মানুষ কিন্তু থেমে থাকেননি।তারা গবেষণা করেছেন। সমস্যার গভীরে ঢোকার চেষ্টা করেছেন। বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধান করেছেন। তারা খুঁজে পেয়েছেন-‘সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র অনুযায়ী কাজ করার ক্ষেত্রে বিকৃতি, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ও গভীর করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক পরিচালন ব্যবস্থায় সময়মতো পরিবর্তন আনতে না পারা, বিপ্লবী নৈতিকতার মানের অবনতি এবং মতাদর্শগত ক্ষেত্রে গুরুতর বিচ্যুতি পার্টি ও রাষ্ট্র থেকে জনগণের ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার ভিত্তিভূমি রচনা করেছে। এর ফলে ভেতরের ও বাইরের প্রতি বিপ্লবী শক্তি গুলি সমবেতভাবে সমাজতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করার তৎপরতা চালিয়ে যেতে পেরেছে।’ পরাজিত পুঁজিবাদী শক্তি শতগুণ শক্তি নিয়ে পাল্টা আঘাত হানতে পারে – লেনিনের এই সতর্কবাণী মনে রাখা হয়নি। সমসাময়িক বিশ্ব বাস্তবতার মূল্যায়ন ও সমাজতন্ত্রের ধারণার ক্ষেত্রে ভুল ছিল। সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের অধ্যায়ে যে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সেদিকে যথাযথ মনোনিবেশ করা হয়নি। অনুসন্ধান এখানেই শেষ নয়।আরও গভীরে ঢোকার চেষ্টা জারি রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় এই শিক্ষাই সামনে এনেছে যে, মার্কসবাদ আপ্তবাক্য না, মার্কসবাদ বিজ্ঞান। মার্কসবাদ মানব সমাজের বিকাশের ধারাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করেছে। এই মতবাদ সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ করতে শ্রমজীবী মানুষকে সক্ষম করে তোলে।
এই বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নতুন পরিস্থিতির নতুন বৈশিষ্ট্যগুলি বুঝতে হবে। কাঠামোগত সঙ্কটে বিপর্যস্ত পুঁজিবাদকে ভালভাবে বুঝতে হবে। আজকের পুঁজিবাদী বিশ্বে ভারতের অবস্থান ও সঙ্কটের চরিত্র যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হবে। ভারতকে ভালভাবে চিনতে হবে। এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কীভাবে শ্রমজীবী মানুষকে সচেতন ও সংগঠিত করা যায় এবং তাদের লড়াইকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায় তার পন্থা বের করতে হবে। কাউকে নকল করে সে কাজ হবে না। গভীর অনুশীলন ও প্রয়োগসিদ্ধ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা এ কাজে আমাদের মস্ত বড় সাহায্যকারী হয়ে উঠতে পারে। নভেম্বর বিপ্লব , সমাজতন্ত্রের সাফল্য, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় সবকিছু থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখা দরকার শ্রমজীবী মানুষের মতাদর্শগত হাতিয়ার মার্কসবাদই।এই হাতিয়ারকে যথাযথভাবে ব্যবহার করার জন্য একে শান দেওয়া দরকার। সমাজ সভ্যতা থেমে থাকতে পারেনা। এর পরিবর্তন হয়েই চলেছে। তবে পরিবর্তনটা ভালোর দিকে , অর্থাৎ শোষণ মুক্ত সমাজের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মার্কসবাদকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার যোগ্যতা অর্জন করতেই হবে।