আধুনিক ভারত ইতিহাসের সর্বাধিক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় নিঃসন্দেহে ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রাম। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বহুমাত্রিক উপাদান জুড়ে রয়েছে , নানান অপ্রত্যাশিত বাঁক রয়েছে বলেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পাঠ আমাদের গভীর মনোযোগ এবং বস্তুনিষ্ঠ মানসিক স্থিতি দাবি করে। নইলে পদে পদে বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা। লাখো লাখো নাম না জানা, স্বল্প চেনা বিপ্লবী চরিত্র থেকে জাতীয় নায়ক, বীর শহীদের রক্ত – ঘাম- অশ্রুর বিনিময়ে প্রায় দুই শতকের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা সংগ্রাম আজও জাতির জীবনে ঝড় তোলে, আজও রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতির প্রতিটা ক্ষেত্রে সমান প্রাসঙ্গিক ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর লড়াই। আর প্রাসঙ্গিক বলেই কেন্দ্রের বর্তমান শাসক দল বিজেপি এবং তার মতাদর্শগত ভিত্তি ভূমি আরএসএস দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেদের কলংকিত অধ্যায়কে লুকোতে চায় ইতিহাস বিকৃতির মধ্যে দিয়ে। কখনো সাভারকার কখনো ভগৎ সিং আবার কখনো বা সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলকে সুকৌশলে নিজেদের প্রচারের কাজে লাগায় আরএসএস – বিজেপি। স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষ পূর্তির ঐতিহাসিকলগ্নে দাঁড়িয়ে ভীষণ জরুরী কাজ হলো ইতিহাসের পুন:পাঠ। কিভাবে দেশের অগণিত মানুষের বলিদানে , কৃষক – শ্রমিকের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে স্বাধীনতা এসেছিলো, সেদিন জাতীয় কংগ্রেস, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কি ভূমিকা ছিলো আর আজ যারা স্বঘোষিত দেশপ্রেমিক তাদের বিশ্বাসঘাতকতা কি ভয়ংকর বিভীষিকা হিসাবে জনজীবনে নেমে এসেছিলো তা জানা – বোঝা জরুরি।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে স্পষ্টতই তিনটি ধারা বিদ্যমান ছিলো। এক – জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক লড়াই আন্দোলন। দুই – সশস্ত্র বিপ্লববাদী গুপ্ত সমিতি গুলির বোমা বন্দুকের লড়াই। তিন – ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক – কৃষকের শ্রেণী সংগ্রাম। কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে দাবি দাওয়া আদায়ের লড়াইয়ের সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামের মেলবন্ধন। এই তিন ধারার লড়াইয়ের ফসল ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট দেশের স্বাধীনতা। আর সেই সময় যারা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ত্রি সীমানায় ছিলো না আজ তারাই নাকি দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট বিলোবে!
ব্রিটিশ রাজশক্তি প্রথম দিন থেকেই চিনে নিয়েছিলো কারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শত্রু। আর শুধু চিহ্নিত করেই খান্ত হয়নি একের পর এক মামলা মোকদম্মায় জর্জরিত করে বিপ্লবের যেকোনো অংকুরকে উত্থানেই দলে পিষে শেষ করতে চেয়েছে । এমনই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মামলা , “লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা”। ১৯০৮ সালে মুজাফফরপুর ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শুরু করে কমিউনিস্ট পার্টি কে খতম করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশদের করা মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা – মোট ১৭ টি মামলার মধ্যে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা অন্যতম। এখানে “ষড়যন্ত্র” শব্দটি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিসের ষড়যন্ত্র? কাদের ষড়যন্ত্র! কাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র? এক্ষেত্রে আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে ব্রিটিশ সরকার তখন সরাসরি ভারতের শাসনকর্তা। তাই ব্রিটিশ বিরোধী যেকোনো উদ্যোগ যা ব্রিটিশ রাজশক্তির উৎখাত কামনা করে তা ব্রিটিশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে “ষড়যন্ত্র” বলে দাগিয়ে দিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ “ষড়যন্ত্র” মামলা সাজাতো। ব্রিটিশ সরকার প্রথম “ষড়যন্ত্র” মামলা করেছিল ১৯০৮ সালে অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড কে হত্যার প্রচেষ্টায় যুক্ত থাকা দুই অমর বাঙালি বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর বিরুদ্ধে। ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি হয় বিচারের প্রহসনে আর প্রফুল্ল চাকি আত্মহত্যা করেন ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা দেবেন না বলে।
লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা নামে দুটি পৃথক মামলা দায়ের হয়েছে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে। প্রথমটি ১৯১৫ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রাসবিহারী বসু উত্তর ভারতে এক সশস্ত্র বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটাবার পরিকল্পনা করেন । এই সময় গদরপন্থী কয়েক শত শিখ ও পাঞ্জাবি যুবক ‘কোমাগাতামারু’ ও ‘তোশামারু’ নামে দুই জাহাজে করে পাঞ্জাবে ফিরে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে সচেষ্ট হলে রাসবিহারী বসু দেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তোলার অনুকূল পরিস্থিতিকে কাজে লাগান । এই উদ্দেশ্যে তিনি ব্রিটিশ সেনানিবেশের ভারতীয় সৈনিকদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ স্থাপন করেন ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারি দিল্লি, লাহোর, আম্বালা, রাওয়ালপিন্ডি, মিরাট, ফিরোজপুর প্রভৃতি স্থানে সেনাছাউনিতে এক সামরিক অভ্যুত্থানের দিনক্ষণ ধার্য করেছিলেন । ভারতীয় বন্দিদের কারামুক্ত করা ও স্থানীয় প্রশাসন দখল করা ছিল তাঁর লক্ষ্য । দুর্ভাগ্যক্রমে কৃপাল সিং নামক জনৈক বিশ্বাসঘাতক বিপ্লবীদের গোপন কথা ফাঁস করে দিলে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। তার উপর রাসবিহারী বসুর সহকর্মী বিষ্ণু গণেশ পিংলে ১০টি বোমা সহ মিরাটে ধরা পড়ে । পুলিশ ব্যাপক অভিযান চালিয়ে দেড়শোর মতো বিপ্লবীকে বন্দী করে তাঁদের বিরুদ্ধে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ‘লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে । কাতার সিং ও পিংলে -সহ মোট ১৭ জন বিপ্লবীর এই মামলার রায়ে মৃত্যুদন্ড হয় । অভিযুক্তদের মধ্যে ভাই পরমানন্দও ছিলেন। বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়। রাসবিহারী বসুকে প্রধান আসামি রূপে ধরতে পুলিশি তল্লাশি শুরু হলে তিনি গ্রেপ্তার এড়িয়ে পি. এন. ঠাকুর ছদ্মনামে খিদিরপুর থেকে এস.এস. সারুকিমারু জাহাজে করে জাপানে চলে যান । এই ঘটনার পর পাঞ্জাব তথা সমগ্র উত্তর ভারতে বিপ্লবী আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
দ্বিতীয় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলাটি সারা ভারতে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে। সারা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নিরিখেই এই মামলার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। একদিকে কংগ্রেসের নরমপন্থীদের নেতৃত্বে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতা অন্যদিকে রুশ বিপ্লবের অভিঘাতে সারা বিশ্ব জুড়েই মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার। দুই মিলে ভারতের মাটিতে ক্রমে ক্রমে দাগ কাটতে শুরু করেছে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা। ভারতে গড়ে ওঠা সদ্যোজাত কমিউনিস্ট পার্টিকে গর্ভগৃহেই শেষ করে দিতে ব্রিটিশরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। একের পর এক মামলা সাজানো হয় কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের ওপর। ব্রিটিশ পুলিশের সাজানো পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা ( ১৯২২-২৩) ,কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা ( ১৯২৪) আর পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘতম মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ( ১৯২৯) , সেই অল্প সময়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে কমিউনিস্টদের আপোসহীন লড়াইয়ের সাক্ষ্য বহন করে।
এরই সাথে ঝিমিয়ে পড়া সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের গাঙে নতুন জোয়ার আসে। এই সময়েই ভারতের মাটিতে উল্কার গতিতে উত্থান হয় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র যার প্রভায় আজও আলোকিত হয় , উজ্জীবিত হয় আপামর দেশবাসী। শহীদ – এ – আজম ভগৎ সিং। মাত্র ১২ বছর বয়সে জলিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যালীলা দাগ কেটে গিয়েছিল বালক ভগৎ সিং এর মনে। বাবা কিষেন সিং সান্ধু এবং কাকা অজিত সিং ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ভগৎ সিংয়ের বিপ্লবী চরিত্রের একটা বড় দিক ছিলো তার অসাধারণ জ্ঞান তৃষ্ণা। বাকুনিন, লেনিন, মার্কস, ট্রটস্কির রচনা ছাত্রাবস্থায় উদ্বুদ্ধ করে তাকে। পাঞ্জাবে যুবদের সংগঠিত করার কাজে নিযুক্ত হন ভগৎ সিং। কৈশোর না পেরোতেই ১৯২৫ সালে গড়ে তোলেন নওজোয়ান ভারত সভা। পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ – বিভাজনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে ভগৎ সিংয়ের যুব সংগঠন। ধর্ম এবং ভূমি সংস্কার বিষয়ে বৈপ্লবিক মনোভাব অল্প সময়ের মধ্যেই বহু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করে। আজ ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন আদতে ভগৎ সিং এর বিপ্লবী সত্তা এবং ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। ১৯৮০ সালে নওজোয়ান ভারত সভা ও অন্যান্য বাম প্রগতিশীল যুব সংগঠন মিলে তৈরি হয় ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন।
দ্রুত ভগৎ সিং জড়িয়ে পড়েন সশস্ত্র বিপ্লববাদী আন্দোলনে কিন্তু তার চেতনায় সর্বদা জাগরুক ছিলো লেনিনের সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন। মানব মুক্তির দিশারী লেনিনের পথেই বিপ্লব দেশের মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা আনতে পারে এই বিশ্বাস যুবক ভগৎ সিং এর মনে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছিল। কাঁকরি ট্রেন লুণ্ঠনের ঘটনায় রামপ্রসাদ বিসমিল, আশফাকুল্লা খাঁর ফাঁসি হলেও চন্দ্র শেখর আজাদ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। ভগৎ সিং এবং চন্দ্রশেখর আজাদ মিলে হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন কে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হন। ১৯২৮ সালে ভগৎ সিংয়ের প্রস্তাবে এবং উদ্যোগেই হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এর নাম পরিবর্তিত হয়ে সোশ্যালিস্ট শব্দ যুক্ত হয়। সংগঠনের নতুন নামকরণ হয় হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন। ১৯২৬ সালের অক্টোবরে লাহোরে একটি বোমা ফাটার ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে ব্রিটিশ পুলিশ ১৯২৭ সালের মে মাসে প্রথমবারের জন্যে যখন তাকে গ্রেপ্তার করে তখন ভগৎ সিংয়ের বয়স মাত্র উনিশ।
এই সময়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সারা ভারত জুড়েই শ্রমজীবী মানুষের লড়াই সংগ্রামে জোয়ার আসে। জাতীয় কংগ্রেসের ভেতরে থেকে কমিউনিস্টরা প্রতিটি কংগ্রেস অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব আনছেন, প্রতিনিধিদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা সঞ্চার করছেন কিন্তু কংগ্রেসের ভেতরে থাকা বুর্জোয়া নেতৃত্বের আপোসকামী মনোভাবে তা প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। কলকাতায় ১৯২৮ সালের কংগ্রেস অধিবেশনে বামপন্থীদের নেতৃত্বে অধিবেশন স্থলে বিপুল সংখ্যায় শ্রমিক – কৃষক হাজির হয়ে পূর্ণ স্বরাজের দাবিতে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেন। মুম্বাইয়ের সুতাকলে শ্রমিকরা কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ধর্মঘট পালন করছেন। শেষমেষ ১৯২৯ সালের লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস পূর্ন স্বাধীনতার প্রস্তাব পাস করে।
সবমিলিয়ে ভগৎ সিংয়ের বিপ্লবী কার্যকলাপের জমি তৈরি হচ্ছিল দেশের ভেতরে। মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিফর্মের ফলাফল খতিয়ে দেখতে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৯২৭ সালের নভেম্বর মাসে সাত সদস্যের একটি কমিশন তৈরী করল। কমিশনের সদস্যরা সকলেই ব্রিটিশ এম.পি। কমিশনের চেয়ারম্যান হলেন স্যার জন সাইমন। সদস্যদের একজন ছিলেন ক্লেমেন্ট অ্যাটলী- যিনি ছিলেন সেসময় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একজন জুনিয়র লেবার এম পি।
কমিটিতে কোনো ভারতীয় সদস্য’র জায়গা না হওয়াটা ভারতীয় রাজনৈতিক নেতারা খুব ভালোভাবে নেন নি। ১৯২৭ এর ডিসেম্বর মাসে মাদ্রাজ সম্মেলনে জাতীয় কংগ্রেস সাইমন কমিশন বয়কট করবার সিদ্ধান্ত নেয়। জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগের একটি অংশও সাইমন কমিশন বয়কট করে। জওহরলাল নেহরুর ছোট বোন কৃষ্ণা নেহেরু তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন-‘.. by lack of elementary tact, the British did for us what we could not seem to do ourselves; they unified India.’
ব্রিটিশ সরকারের একটি সম্পূর্ণ ভুল এবং স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ জাতীয় রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদ -বিরোধী আন্দোলনের নতুন ঢেউ তুলল। ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কমিশনের সদস্যরা বম্বে শহরে পা দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কমিশন-বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়ে গেল। হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী কালো পতাকা হাতে “সাইমন গো ব্যাক” ধ্বনিতে কমিশনকে অভ্যর্থনা জানালেন। বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর পুলিশি লাঠিচার্জ ভারতের বিভিন্ন শহরে একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ালো। ৩০শে অক্টোবর কমিশন লাহোরে পদার্পণ করলে লালা লাজপত রাই স্বয়ং কমিশন -বিরোধী মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হলেন। লাঠিচার্জে তিনি মারাত্মক ভাবে জখম হন। সেই চোট আর সারে নি। সে বছরই নভেম্বর মাসের ১৭ তারিখে তিনি মারা যান। যদিও ব্রিটিশ পুলিশ রিপোর্টে লালা লাজপত রাইয়ের মৃত্যুর কারণ হিসাবে হৃদ রোগের কারণ নথিভুক্ত করে।
লালা লাজপত রাই ব্রিটিশের জেলে ভগৎ সিংয়ের কাকা অজিত সিং এর সহ জেল বন্দী ছিলেন। ভগৎ সিংয়ের হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (HSRA) লালা লাজপত রাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ নেয়। সেদিন ব্রিটিশ সুপার জেমস অ্যান্ডারসন স্কটের নেতৃত্বে লাঠিচার্জ করে ব্রিটিশ পুলিশ। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত শিবরাম রাজগুরু, চন্দ্র শেখর আজাদ, শুকদেব থাপার এবং ভগৎ সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ সুপার জন স্যান্ডার্স কে গুলি করে খুন করে ঠিক এক মাস বাদে ১৭ ই ডিসেম্বর। যদিও হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এই খুনের দায় স্বীকার করে লিফলেট ছড়ায় গোটা শহর জুড়ে যেখানে চন্দ্র শেখর আজাদ , বলরাজ ছদ্মনামে নিজেদের উদ্দেশ্যের কথা স্পষ্ট করে জানায়। লিফলেটে খুনের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেও স্যান্ডার্স খুনের অনিবার্যতার কথা স্পষ্ট করে বিপ্লবীরা। এবং বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণ মুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করা হয়। “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক” ( লং লিভ রেভোলুশন) এই শ্লোগানে লিফলেট শেষ হয়।
স্যান্ডার্স খুনের পর ব্রিটিশ পুলিশের কড়া নজরবন্দী এড়িয়ে ভগৎ সিংয়ের লাহোর থেকে পলায়ন ভীষন চিত্তাকর্ষক। ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ভগবতী চরণ ভোরার বাঙালি স্ত্রী দুর্গাবতী দেবী ( দুর্গা ভাবি) ভগৎ সিং এর স্ত্রী সেজে হাওড়া গামী ট্রেনে চেপে বসেন। ভগৎ সিং দাঁড়ি গোঁফ কামিয়ে পুরোদস্তুর পশ্চিমী পোশাকে সজ্জিত হয়ে বেরোলেন লাহোর থেকে। রাজগুরু এই “দম্পতির” চাকর সেজে সঙ্গে থাকলো। লখনউ থেকে ট্রেন পাল্টে হাওড়া পৌঁছন ভগৎ সিং এবং দূর্গাবতী দেবী। ভগৎ সিং বাদে বাকিরা কয়েকদিন বাদেই লাহোর ফিরে আসেন।
কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর ভগৎ সিং হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের সভায় প্রস্তাব রাখেন যে দিল্লির সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে অল্প মাত্রার বোমা ছুঁড়ে তাদের উদ্দেশ্যের কথা সারা বিশ্বের দরবারে জানান দেবেন। এক্ষেত্রে তিনি ফ্রান্সের নৈরাজ্যবাদী অগাষ্ট ভালিয়ান্ট এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, যিনি প্যারিসের চেম্বার অব ডেপুটিজে ঠিক অনুরূপ বোমা বর্ষণ করেন। প্রথমে অ্যাসোসিয়েশনের বাকি সদস্যরা কড়া আপত্তি জানালেও ভগৎ সিং এর জেদের কাছে নতিস্বীকার করেন। তারা জানতেন যে ব্রিটিশ পুলিশ জন স্যান্ডার্স হত্যায় ভগৎ সিং কে জড়িয়ে দিলে তার ফাঁসি অনিবার্য। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাবে যিনি অসম্মতি জানিয়ে দেশের ভবিষ্যতের সাথে নিজের বন্ধনকে দৃড় করার শপথ নিয়েছেন তার কাছে এই নির্ঘাৎ মৃত্যু পরোয়ানা কোনো বাঁধা ছিলো না।
এপ্রিল মাসের ৮ তারিখ, ১৯২৯ সাল , ভগৎ সিং এবং তার সহযোদ্ধা বটুকেশ্বর দত্ত সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে দুটি স্বল্প অভিঘাতের বোমা বর্ষণ করেন। ধোঁয়ায় ঢেকে যায় গোটা হল। হুড়োহুড়ির সুযোগে নিশ্চিতভাবেই পালাতে পারতেন দুজন, বদলে হলের ভেতরে দাঁড়িয়ে ইনকিলাব জিন্দাবাদ ( লং লিভ রিভোলুশন) ধ্বনিতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দেন ভগৎ সিং ও তার সহযোগী বটুকেশ্বর দত্ত। গ্রেপ্তার হলেন দুজন। ব্রিটিশ পুলিশ মামলা সাজালো। মে মাসে বিচার শুরু হয় এবং জুন মাসের ১২ তারিখ মাত্র একমাসের বিচারে দুজনেরই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ ঘোষণা করেন বিচারপতি। আসফ আলী বটুকেশ্বর দত্তের হয়ে মামলা লড়েন। অন্যদিকে ভগৎ সিং নিজেই নিজের হয়ে সাওয়াল করেন।
ইতিমধ্যে লাহোর পুলিশ হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের দুটি বোমা কারখানার হদিশ পায়। এপ্রিল মাসের ১৫ তারিখে লাহোরে এবং কিছুদিন বাদেই সাহারানপুরের বোমা কারখানায় ব্রিটিশ পুলিশ ছাপা মেরে শুকদেব, কিশোরীলাল, জয় গোপাল সহ সমিতির বেশ কিছু বিপ্লবী সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। দুর্ভাগ্যবশত তাদের মধ্যে কেউ কেউ পুলিশের কাছে গোপন তথ্য ফাঁস করে দেয়। লাহোর পুলিশ স্যান্ডার্স হত্যা, অ্যাসেম্বলিতে বোমা বর্ষণ এবং বোমা কারখানা স্থাপন – তিনটে ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পায়। হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এবং ভগৎ সিং। হংস রাজ ভোরা এবং জয় গোপাল নামে দুজন বিপ্লবী সদস্য বিশ্বাসঘাতকতা করে রাজ সাক্ষী হতে রাজি হয়ে যায়। তাদের সাক্ষ্য প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ পুলিশ ফের মামলা সাজায় ভগৎ সিংয়ের বিরুদ্ধে। ভগৎ সিং, শুকদেব, রাজগুরু ছাড়াও আরো ২১ জন বিপ্লবী সদস্যের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ পুলিশ যে মামলা সাজায় ,ইতিহাসে তাই লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা নামে খ্যাত।
দিল্লির সেন্ট্রাল জেল থেকে লাহোরের মিয়াওয়ালি জেলে স্থানান্তরিত করলে সেখানের জেলের কয়েদিদের দুরবস্থা দেখে এবং নিজেদের জন্যে রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদা লাভের জন্যে ভগৎ সিং ও তার সঙ্গী সাথীরা একযোগে অনশন আন্দোলন শুরু করেন। বন্দীদের ভুখ-হরতালের খবর জেলের বাইরে এলে দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ৩০ শে জুন পাঞ্জাব জুড়ে ভগৎ সিং-বটুকেশ্বর দত্ত দিবস পালন করা হয়। লাহোরে নগর কংগ্রেস কমিটির ডাকা সভায় প্রায় দশ হাজার মানুষ যোগদান করেন। অমৃতসরে অনুরূপ একটি সভায় হাজার পাঁচেক মানুষ জড়ো হন। ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তকে যথাক্রমে পাঞ্জাব ও বাংলার গৌরব বলে বর্ণনা করা হয়। শিগগিরই খবর আসে লাহোর জেলেও বিচারাধীন বন্দীরা ভুখ হরতাল শুরু করেছেন। লাহোরে কংগ্রেস ও যুব লিগের কর্মীরা লাল কাপড়ে অনশনরত বন্দীদের ছবি টাঙিয়ে মিছিল করেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহিলারা অনশনরত বন্দীদের উদ্দেশ্যে রক্তে-ভেজানো রাখী উপহার পাঠান। যে উদ্দেশ্যে ভগৎ সিং অ্যাসেম্বলিতে দুটি সল্প মাত্রার বোমা ছুঁড়ে ছিলেন সেই উদ্দেশ্য তাদের অনেকাংশে সফল হয়। সারা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তাদের এই অসম সাহসী লড়াই দেশের যুব সমাজের হৃদয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নতুন করে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়।
অগাস্টের শুরুতে অ্যাসেম্বলি-সদস্য ডঃ গোপিচাঁদকে পাঠানো হয় অনশনকারীদের বুঝিয়েসুঝিয়ে অনশন ভাঙ্গার জন্য। কিন্তু তিনি ফিরে এসে পাঞ্জাব সরকারের কাছে নিজের ব্যর্থতা কবুল করেন। অনশন ভাঙবার উদ্দেশ্যে জেল কমিটি জেলের বিভিন্ন জায়গায় খাবার রাখা, জলের কলসিতে দুধ ভরে রাখার মত নানান কৌশলের আশ্রয় নেয়; কিন্তু বন্দীদের মনোবল অটুট থাকে। অনশন চলতেই থাকে। জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। যতীন দাশের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। সহবন্দী যতীন্দ্রনাথ সান্যল ও অজয় ঘোষ পরে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন যে সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধটা খিদের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল নিজেকে-বাঁচানোর ইন্সটিংক্টের বিরুদ্ধে।
প্রবল জনমতের চাপে দ্রুত বিচার শেষ করে বিপ্লবীদের ফাঁসিতে লটকে দেবার তাগিদে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড আরউইন ১লা মে ,১৯৩০ সালে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেন। যদিও ট্রাইব্যুনাল গঠনের এই অর্ডিন্যান্সটি কখনোই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ হয় নি। এই বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একমাত্র ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিলেই আবেদন করা যেতে পারে। ৭ই অক্টোবর, ১৯৩০ সালে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তার রায় দেয়। তিনশো পাতার রায়ে ট্রাইব্যুনাল ২১ জন অভিযুক্তর মধ্যে ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুর ফাঁসির আদেশ দেয় জন স্যান্ডার্স এর খুন এবং ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে। বাকি অভিযুক্তদের মধ্যে কুন্দন লালের সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। প্রেম দত্তের পাঁচ বছর জেল হয়। কিশোরীলাল, বিজয় কুমার সিনহা, মহাবীর সিং, শিব ভার্মা, গয়া প্রসাদ , জয়দেব ,এবং কমলনথ তিওয়ারির আন্দামান সেলুলার জেলে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা হয়। অজয় ঘোষ, যতীন্দ্রনাথ সান্যাল এবং দেসরাজ বেকসুর খালাস পান।
ডিফেন্স কমিটি প্রিভি কাউন্সিলে আপীল করবার প্রস্তুতি নেয়। ভগৎ সিং শুরুতে এই আপীলের ব্যাপারে রাজী ছিলেন না; কিন্তু পরে তাঁর মনে হয় আপীল করলে ব্রিটেনে HSRA-র পক্ষে জনমত গঠিত হতে পারে। প্রিভি কাউন্সিলে অবশ্য আপীলটি খারিজ হয়ে যায়। শেষ চেষ্টা হিসেবে কংগ্রেস সভাপতি মদন মোহন মালব্য ভাইসরয়ের কাছে একটি মার্সি পিটিশন দাখিল করেন। সেটিও যথারীতি খারিজ হয়। কিছু বিপ্লবী গান্ধীকে হস্তক্ষেপ করতে বলেন। নীরবতা ভেঙে ১৯শে মার্চ, ১৯৩১ সালে ভাইসরয়ের সঙ্গে তাঁর নির্ধারিত মিটিংয়ে এই বিষয় নিয়ে গান্ধি কথা বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভাইসরয় ব্যাপারটি উড়িয়ে দেন।
ভগৎ সিং ও জেল বন্দী অন্যান্য বিপ্লবীদের জেল থেকে ছাড়ানোর পরিকল্পনা করেন দুর্গা ভাবির স্বামী ভগবতী চরণ ভোরা কিন্তু বোমা তৈরি করার সময় বিস্ফোরণে মারা যান। পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
অবশেষে ১৯৩১ সালের ২৪ শে মার্চ লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় ব্রিটিশ বিচারে দোষী সাব্যস্ত ভগৎ সিং, রাজগুরু, এবং শুকদেবের ফাঁসির দিন নির্দিষ্ট করা হয়। কিন্তু একদিন আগেই ২৩ শে মার্চ, সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় নির্দিষ্ট সময়ের ১১ ঘণ্টা আগে চূড়ান্ত গোপনীয়তায় লাহোর জেলে তিন বীর বিপ্লবীর ফাঁসির সাজা কার্যকর করা হয়। কোনো ম্যাজিস্ট্রেট সেদিন ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার কাজ তদারকিতে রাজি না হওয়ায় একজন বিচারকের তত্ত্বাবধানে একাজ করা হয়। জনরোষের ভয়ে ব্রিটিশ পুলিশ এরপর লাহোর জেলের পেছনের দেওয়াল ভেঙে তিন শহীদের মৃতদেহ বার করে গন্ডা সিং ওয়ালা গ্রামে রাতের অন্ধকারে শেষকৃত্য সম্পন্ন করে ফিরোজপুর থেকে ১০ কিমি দূরে শতদ্রু নদীতে ভস্মাবশেষ বিসর্জন করে।
এভাবেই যবনিকা পতন হয়েছিল লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা এবং সেই মামলায় তিন অমর শহীদের নশ্বর জীবনে। একথা আজ বলাই বাহুল্য যে ভগৎ সিং ,শুকদেব, রাজগুরুর অবিনশ্বর বিপ্লবী চেতনা আজও দেশবাসীর হৃদয়ে জাগরুক। মাত্র ২৩ বছর ৫ মাস ২৪ দিনের ছোট্ট জীবনে ভগৎ সিং যে দাগ কেটে গেছেন তা আজও পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের মনে বারুদ স্তম্ভে স্ফুলিঙ্গের কাজ করে, হতাশার অন্ধকারে আলোকশিখা জ্বালিয়ে রাখে। ভগৎ সিংয়ের জীবন একটি আদর্শ উদাহরন হতে পারে কিভাবে সশস্ত্র বিপ্লবের ব্যক্তি হত্যার আপাত সহজ এবং জনপ্রিয় পথ থেকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে , সাম্যবাদের শ্রেণী চেতনায় উত্তরণ ঘটানো সম্ভব।
আরেক বিশ্ববন্দিত বিপ্লবী চে গুয়েভারা বলতেন, “বিপ্লবী হতে চাও, বিপ্লবের প্রথম শর্ত, শিক্ষিত হও।” ক্ষুদ্র রাজনৈতিক জীবনে ভগৎ সিং নিরন্তর মগজে শান দিয়ে গিয়েছেন। পত্র পত্রিকায় নিয়মিত লিখে গেছেন নিজের ভাবনার কথা স্পষ্ট ভাষায়। ওই বয়সেই পড়ে ফেলেছিলেন বাকুনিন, নেনিন, মার্কস, ট্রটস্কির রচনা। গান্ধীজি কর্তৃক অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার হবার পর উত্তর ভারত জুড়ে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার প্রেক্ষিতে নিজেকে প্রশ্ন করেন, কেন দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে এই অযথা হানাহানি! এই সময়েই নিজের ধর্ম বিশ্বাস ত্যাগ করেন ভগৎ সিং এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজ বিশ্বাসে অটুট ছিলেন। জেলে বসেই নিজের বিশ্বাসকে লিপিবদ্ধ করতে প্রবন্ধ লিখলেন , “কেন আমি নাস্তিক?”
ফাঁসির দিন এগিয়ে আসছে, জীবনদীপ নিভে যেতে আর বেশিদিন দেরি নেই এমতবস্থায় জেলে তার এক সহবন্দী রণধীর সিং যখন তাকে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে বললেন, ভগৎ সিং দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করে লিখলেন, “আমার নাস্তিকতার কথা জানতে পেরে আমার এক বন্ধু আমায় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে অনুরোধ করলেন, বললেন আমি শেষ দিনে নিশ্চিতভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাসী হবো। আমি তাকে বললাম না বন্ধু এমনটা কখনোই হবে না। এটা ঘটলে নিশ্চিতভাবে সেটা অনৈতিক এবং মূল্যবোধহীনতার পরিচয় হবে। এমন তুচ্ছ ব্যক্তিগত স্বার্থে আমি প্রার্থনা করবো না। এটা কি আমার ঔদ্ধত্য! যদি হয় তবে তাই ।”
মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ভগৎ সিং নিজের বিচারবোধ , নিজের বিশ্বাস থেকে একচুল নড়েননি কিন্তু তার রাজনৈতিক চেতনার অভূতপূর্ব উত্তরণ ঘটেছিল। লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় বিচার চলাকালীন ১৯৩০ সালের ২১ শে জানুয়ারি ভগৎ সিং এবং হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের বাকি সহবন্দীরা লাল স্কার্ফ গলায় বেঁধে এসে কোর্ট রুমের ভেতরেই শ্লোগান তোলেন। “লং লিভ কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল।” “ডাউন উইথ ইমপেরিয়ালিজম”। কোর্ট রুমে উপস্থিত ম্যাজিস্ট্রেটকে অনুরোধ করেন তৃতীয় আন্তর্জাতিকে যেনো তাদের একটি বার্তা টেলিগ্রাম করে দেওয়া হয়। বার্তায় লেখা ছিল, “ We wish success to the great experiment Russia is carrying out. We join our voice to that of the international working class movement. The proletariat will win. Capitalism will be defeated. Death to Imperialism”. সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে বোমা ছোড়ার সাথে যে লিফলেট বিতরণ করেছিলেন সেখানে লেখাছিল, “It is easy to kill individual but you cannot kill the ideas. Great empires crumbled while the ideas survived”
জেলখানা থেকে তাঁর লেখা শেষদিককার চিঠিগুলিতে ভগৎ সিং বলেন-“ম্যায়ঁ আতংকারি নহিঁ হুঁ, ম্যায়ঁ এক ক্রান্তিকারি হুঁ। বলেন, “বিপ্লবী জীবনের শুরুর দিককার কিছুদিন বাদ দিলে তিনি কখনো সন্ত্রাসবাদে আগ্রহ দেখান নি। এ-ও বলেন- “বম ফেঁকনা, না সির্ফ বেকার, বলকি নুকসানদায়ক হ্যায়।” বোমা-বন্দুক কেবলমাত্র কিছু বিশেষ ক্ষেত্রেই ব্যবহার করবার দরকার হতে পারে, কিন্তু আসল কাজ কৃষক-শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা। ভবিষ্যতের কমিউনিস্ট পার্টিতে সামরিক বিভাগের প্রয়োজনীয়তা তিনি স্বীকার করেন, কিন্তু তা যেন সর্বদাই সুশৃংখল ভাবে পার্টির অধীনস্থ থাকে। সিং ততদিনে বাকুনিন পেরিয়ে মার্ক্স, লেনিন ও ট্রটস্কি আত্মস্থ করেছেন। তাঁর অনুরাগীদের তিনি মনে করিয়ে দেন, উদ্দেশ্যসাধনের জন্য মৃত্যুবরণ করাই একমাত্র জরুরি কাজ নয়, বেঁচে থেকে লড়াই চালিয়ে যাওয়াও জরুরি। পাঞ্জাব স্টুডেন্ট্স কনফারেন্সের সদস্যদের তিনি বলেন বোমা-পিস্তল ছেড়ে গান্ধীবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতে। যখন জিজ্ঞাসা করা হয় তাঁর শেষ ইচ্ছা কী, তিনি বলেন- লেনিনের জীবনী পড়তে শুরু করেছেন,ফাঁসির আগে তিনি সেটি শেষ করে যেতে চান। ( ক্লারা জেটকিনের লেখা বই Reminiscence of Lenin)
আজকের বাম যুব আন্দোলনের কর্মীরা ভগৎ সিংয়ের বিপ্লবী চেতনার, ধর্মনিরপেক্ষ বলিষ্ঠ বিশ্বাসের উত্তরাধিকারী। ভগৎ সিংয়ের সমাজতান্ত্রিক শ্রেণী আন্দোলনের পথে মানবমুক্তির অনুসারী। কিন্তু শুধুমাত্র এই গর্ব বুকে নিয়ে ঘুরলেই হবে না। নিজ জীবনে ব্যক্তিগত আচরণে, সমাজে ভগৎ সিংয়ের আদর্শে বলীয়ান হয়ে উঠতে হবে। তবেই সাদা ঝান্ডার লাল তারার মাঝে ভগৎ সিং চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন, অমর হয়ে থাকবে তার বীরত্বের গাঁথা।