চীনের তিয়ানজিনে সদ্য সমাপ্ত সাংহাই কোয়াপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)-এর ২৫ তম শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যোগদান ভারতের পররাষ্ট্র নীতিতে আগামীতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশ। বিশ্বের সব থেকে প্রাচীন দুই সভ্যতা এবং সবচেয়ে জনবহুল দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক ঘটনা। “উন্নয়নশীল বিশ্বের দুই গুরুত্বপূর্ণ শরিক হিসেবে ভারত ও চীনের বহুমাত্রিকতা ধরে রাখা, সাম্রাজ্যবাদী তর্জন প্রতিহত করা এবং বহুমেরুর বিশ্ব গড়ে তোলা ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা।” ভারত ও চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতিকে স্বাগত জানিয়ে একথা বলেছেন সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদক এম এ বেবি। নয়াদিল্লি ও বেজিঙয়ের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ৭৫ বছর পূর্তিতে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং পারস্পরিক বন্ধুত্বের মাধ্যমে সহযোগিতা বাড়ানো ও তা মজবুত করা আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিতে অত্যন্ত জরুরি। নরেন্দ্র মোদি এবং শি জিনপিংয়ের মধ্যে মুখোমুখি বৈঠকে বেশ কিছু সদর্থক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নে ভারত ও চীন একে অপরের শরিক, প্রতিপক্ষ নয়-এই নীতিকে পাথেয় করেই এগবে বেজিঙ ও নয়াদিল্লি। সীমান্ত সমস্যার ‘ন্যায্য, যুক্তিসঙ্গত এবং পারস্পরিকভাবে গ্রহণযোগ্য’ সমাধানে সচেষ্ট হবে দুই দেশ। দুই দেশের মধ্যে যেখানে যেখানে মতের অমিল আছে তা আলোচনার মধ্যে দিয়েই মেটানো হবে। একুশ শতকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, বহুমেরুর বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে পারস্পরিক মর্যাদা, স্বার্থ ও সংবেদনশীলতার ভিত্তিতে এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য দুই প্রতিবেশী দেশ এগিয়ে যাবে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের প্রকাশিত এক বিবৃতি সূত্রে এমনটাই জানা গিয়েছে।
চাটুকারিতার সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করেও মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাপিয়ে দেওয়া ৫০ শতাংশ আমদানি শুল্ক ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। একমাত্র ব্রাজিল বাদে অন্য সমস্ত দেশের থেকে ভারতের উপর আমদানি শুল্ক বেশি চাপিয়েছেন ট্রাম্প। ভারতের উপর প্রথম ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপানো হয়েছিল। ভারত রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল এবং অস্ত্র কেনায় ‘জরিমানা’ এবং ‘শাস্তি’ বাবদ ভারতের উপর আরো ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছে আমেরিকা। অথচ আমেরিকা নিজেই রাশিয়া থেকে ইউরেনিয়াম ও সার আমদানি করে। “আপনি আচারি ধর্ম পরকে শেখাও”-বাংলায় বহুল প্রচলিত এই প্রবাদ বাক্যটি মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন। ট্রাম্প ঠিক করে দেবেন নাকি ভারতের বৈদেশিক নীতি কি হবে ? ট্রাম্পের ঘোষনা মতো গত ২৭ শে আগস্ট’২৫ থেকে ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক লাগু হয়ে গিয়েছে। ভারত থেকে কৃষি ও শিল্পজাত পণ্য, বস্ত্র, গাড়ি, যন্ত্রাংশ, গয়না, ইস্পাত ইত্যাদি দ্রব্য আমেরিকায় আমদানি করা বেশ কঠিন হয়ে উঠবে। এর ফলে এদেশে শ্রমিক কর্মহীন হবে। গণছাঁটাই, কম মজুরিতে কর্মী এবং অস্থায়ী ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। আমেরিকার এহেন আচরণে গত দশ বছর ধরে মোদি সরকারের পশ্চিম-নির্ভর বিদেশ নীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। ভারতের উপর এই মাত্রাতিরিক্ত শুল্ক চাপানোর তীব্র নিন্দা করে চীন বলেছে “এমন আচরনের বিরুদ্ধে নীরব থাকলে এই ধরনের ‘মস্তানদের’ আরও সুযোগ দেওয়া হয়। চীন ভারতের পাশে আছে।” আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত অক্ষশক্তি যে ভারতের পক্ষে একেবারেই নির্ভরযোগ্য নয় তা পহেলগামে জঙ্গি হামলা এবং তারপর ‘অপারেশন সিঁদুর’ থেকে ঠেকে শিখেছেন মোদি। অন্তত ২৫ বার ভারত পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বিরতির সমঝোতা করিয়ে দেওয়ার দাবি করেছেন ট্রাম্প। বিশ্লেষকদের মতে, আমেরিকার চাপানো শুল্কের চাপেই মোদি সরকারের টনক নড়েছে এবং তার জন্যই এসসিও-র মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেছে নয়াদিল্লি।
পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের উপস্থিতিতেই এসসিও সম্মেলনে দ্ব্যর্থহীনভাবে পহেলগামে জঙ্গি হামলার তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। নিন্দা করা হয়েছে প্যালেস্টাইনের গাজা ভূখণ্ডে ইজরায়েলের গণহত্যার। ইজরায়েলের অতি দক্ষিণপন্থী সরকারের অমানবিক আচরনের প্রতি বিরক্ত হয়ে কানাডা, ফ্রান্স, ব্রিটেন সহ বহু পশ্চিমা দেশ তাদের চিরাচরিত অবস্থান পাল্টাতে বাধ্য হচ্ছে। গাজায় ত্রান সামগ্রী ঢুকতে না দিলে ইজরায়েলের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর হুমকি দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। পৃথিবীর ১৯৩ টি দেশের মধ্যে ১৪৮ টি দেশ স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। গাজায় গণহত্যার জেরে কূটনৈতিকভাবে ইজরায়েলের যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানেয়াহুকে ‘যুদ্ধ অপরাধে’ দোষী সাব্যস্ত করে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। গাজায় নেতানেয়াহুর বর্বরচিত কাজে সরাসরি সমর্থন করছেন ট্রাম্প। অথচ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধের জন্য তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কির সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করেছেন। অবশ্য পুতিন তাঁকে যথাযোগ্য জবাবও দিয়েছেন। আর পাঁচটা উন্নয়নশীল দেশকে ধমকে চমকে ট্রাম্প যেমন জবরদস্তি তাঁর শর্ত চাপিয়ে দিতে অভ্যস্ত, রাশিয়ার ক্ষেত্রে তা পারেন নি। পুতিন সামরিক সংঘর্ষ বিরতির বদলে স্থায়ী শান্তি চুক্তির পক্ষে সওয়াল করেছেন। এতেই রাজি হয়েছেন ট্রাম্প। একই সঙ্গে রাশিয়ার একেবারে সীমান্ত ঘেঁষে ন্যাটোর সামরিক বিস্তার বন্ধ করার দাবি করেছেন পুতিন।
এসসিও-র শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে পুতিনের সঙ্গেও কথা হয়েছে মোদির। পুতিন তাঁর গাড়িতে তুলে নিয়েছিলেন মোদিকে এবং প্রায় ৪৫ মিনিট তাঁদের মধ্যে কথা হয়। এই ঘনিষ্ঠতার হাতেনাতে ফল পেয়েছে ভারত। রুশ আকাশ প্রতিরোধী ব্যবস্থা এস-৪০০-র আরোও কয়েকটি ইউনিট পেতে চলেছে ভারত। পুতিন-শি জিনপিং-মোদির একসাথে বসে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের ৮০ বছরপূর্তি উপলক্ষ্যে বেজিঙে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম-জন-উনও হাজির ছিলেন। আমেরিকাকে বাদ দিয়ে বিশ্ব রাজনীতির এ এক সম্পূর্ণ নতুন কূটনৈতিক সমীকরণ। ভারতকে ইতিমধ্যে হুমকি দেওয়া শুরু করেছেন স্বয়ং ট্রাম্প এবং তাঁর প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। এসসিও-র শীর্ষ সম্মেলনে হাজির দেশগুলির এই মহা সমারোহ নাকি “আমেরিকার বিরুদ্ধে চক্রান্ত”-সোশ্যাল মিডিয়ায় এমনই মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প। কয়েকদিন আগেও যে ট্রাম্প তাঁর অপছন্দের রাষ্ট্রনেতাদের মুণ্ডপাত করতেন, এখন তাঁকেই নিশানা করছেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতারা। ২০২৬-এ ভারতে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ব্রিকস সম্মেলন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকার নেতৃত্বে যে একমেরুর দুনিয়া তৈরি হয়েছে, তার পাল্টা বহুমেরুর পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে তৈরি হয়েছে এসসিও, ব্রিকস-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা। এসসিও বিশ্বের ৪২ শতাংশ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। এসসিও দেশগুলির গড় অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ৪.৫ শতাংশ এবং বিশ্বের মোট সম্পদের প্রায় ৩০ শতাংশের মালিকানা এদের হাতে। সেখানে আমেরিকা ও তার শরিকরা বিশ্বের মাত্র ৫ শতাংশ জনসংখ্যার প্রতিনিধি। আমেরিকা ও তার শরিকদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার মোটে ২.৫ শতাংশ এবং এরা বিশ্বের মোট সম্পদের ২৭ শতাংশের মালিক। তাই আমেরিকার পদলেহন না করে ভারতের উচিত চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক এবং বন্ধুত্বের সম্পর্ক বৃদ্ধি করা। ভারত, চীন, রাশিয়া-এই ত্রিশক্তি একত্রে মিলিত হলে বিশ্ব জুড়ে আমেরিকার দাদাগিরি এবং একচ্ছত্র আধিপত্য কমতে বাধ্য। আর এই সত্যটা বুঝতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রায় ১১ বছর সময় লেগে গেল। একেই বোধকরি বিলম্বে বোধদয় বলে।
তথ্যসূত্রঃ দৈনিক গণশক্তি